
ঢাকার পূর্বাচলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচলে নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে জালিয়াতির ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা পৃথক ছয় মামলায় আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। একইসঙ্গে আগামী ১১ ও ১৩ আগস্ট মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের দিনধার্য করেছেন আদালত। দুদক প্রসিকিউটর মীর আহমেদ আলী সালাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন তিন মামলায় এবং বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক রবিউল আলম আরও তিন মামলায় অভিযোগ গঠন করেন। এ বিষয়ে দুদকের প্রসিকিউটর মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, ছয় মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। আসামিরা আদালতে উপস্থিত না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের পৃথক ছয়টি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ৭ সদস্যসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত। মামলায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যরা হলেন- শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক (ববি)।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) তরিকুল ইসলাম বলেন, পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের পৃথক ছয়টি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ৭ সদস্যসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুদকের পক্ষ থেকে অভিযোগ গঠনের পক্ষে আদালতে যুক্তি তুলে ধরা হয়। শুনানি নিয়ে আদালত শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন আদালত। দুদকের পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, সম্প্রতি প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের ছয়টি মামলায় শেখ হাসিনাসহ অন্যদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। পরে মামলাগুলো বিচারের জন্য অন্য আদালতে বদলির আদেশ দেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত।
জানা গেছে, গত ২০ জুলাই রাজউকের প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানাসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে দুদকের করা ছয় মামলা বিচারের জন্য পৃথক দুটি আদালতে বদলি করা হয়। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এবং ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এ তিনটি করে এ ছয় মামলা পাঠানো হয়। মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াছি উদ্দিন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার, সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা, সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কবির আল আসাদ, সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস, সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) নুরুল ইসলাম, সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, সাবেক সদস্য সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) শেখ শাহিনুল ইসলাম, উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমান, হাবিবুর রহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব সালাউদ্দিন।
দুদকের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্লট বরাদ্দের দুর্নীতির অভিযোগে গত জানুয়ারিতে পৃথক ছয় মামলা দায়ের করে দুদক। মামলায় শেখ হাসিনা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল), বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে ও ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও অপর মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকসহ আরও অনেককে আসামি করা হয়। সস্প্রতি সব মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের নামে বরাদ্দ নেওয়া প্লটের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করে দুদক। পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে ছয়টি মামলায় শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে গত ১০ মার্চ অভিযোগপত্রের অনুমোদন দেয় দুদক।
দুদক বলেছে, তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে শেখ হাসিনা নিজ নামে প্লট বরাদ্দ নেন। এই অভিযোগে তাকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে একই প্রকল্পে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্লট জালিয়াতির অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে মাহবুবুল হাসান হত্যা মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ আওয়ামী লীগের ২২১ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। ফেনীতে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করেন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান।
গত বছর ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন কলেজছাত্র মাহবুবুল হাসান। তিনি সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের তরাব পাটোয়ারি বাড়ির মৃত নোমান হাসানের ছেলে। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর মাহবুবুলের বড় ভাই মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান বাদী হয়ে ১৬২ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় আরও ৫০০ জনকে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানা-পুলিশের উপ-পরিদর্শক আলমগীর হোসেন বলেন, মামলায় ৩০ জুলাই পর্যন্ত এজাহারনামীয় ১২ জন ও সন্দেহভাজন ৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিন আসামি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় ঘটনার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, মাহবুবুল হাসান হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ২২১ আসামির মধ্যে এজাহারভুক্ত, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে উঠে আসা নাম ও তদন্তে ঘটনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা রয়েছেন। অভিযোগপত্রে যাদের নাম আছে তারা হলেন : ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ফেনী সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল, ফেনী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী, ছাগলনাইয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেজবাউল হায়দার চৌধুরী, দাগনভূঞা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি দিদারুল কবির, পরশুরাম পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, সোনাগাজী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন মাহমুদ, সোনাগাজী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, ছাগলনাইয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মোস্তফা প্রমুখ।
জানতে চাইলে মামলার বাদী মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান বলেন, তিনি তার ভাইয়ের হত্যায় জড়িত সবার শাস্তি চান। দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিরা বিচারের আওতায় আসুক, এটাই তার চাওয়া।
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে ফেনীতে সাতজন শহিদ হন। এসব ঘটনায় ফেনীতে সাতটি হত্যা মামলা ১৫টি হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২ হাজার ১৯৯ জন এজাহারভুক্ত আসামি, ৪ হাজার অজ্ঞাত আসামি রয়েছেন। এসব মামলায় অন্তত এক হাজার আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।