
আজ ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই) স্বৈরশাসক আওয়ামী লীগের শাসন আমলের উৎখাতের দিন। ২০২৪ সালের এই দিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়। মুক্তি পায় বাংলাদেশের মানুষ। মুক্ত বাতাসে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। ভঙ্গুর অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুমড়ে-মুচড়ে পড়া দেশের হাল ধরেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় এসেই জনআকাঙ্ক্ষাকে পাত্তা না দিয়ে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়। ২০১৪ সালের একতরফা বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকেই একটানা তিনবার নির্বাচন দেন। ভোট কারচুপি ও রাতের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকলেও তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে কিংবা কথা বললে নেমে আসতো নির্যাতনের খড়গ। আওয়ামী লীগ শাসনের অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতা আন্দোলনে নামেন। জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ, শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধসহ প্রায় দুই হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন নাহিদ ইসলাম (বর্তমানে এনসিপির আহ্বায়ক), হাসনাত আবদুল্লাহ (বর্তমানে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক) ও সারজিস আলম (বর্তমানে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক)সহ অনেক সমন্বয়ক। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি রাজপথ দলে রাখেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। সেদিন আওয়ামী লীগ বিরোধী সকলের সমন্বয়ে দেশজুড়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতার মসদ থেকে টেনে নামাতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন ও আহত হয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান। সেই অভ্যুত্থানে সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিভে যায় হাজার হাজার প্রাণ। এর বিনিময়ে অবিস্মরণীয় এক জয়ের দেখা পায় ছাত্র-জনতা। জনবিক্ষোভ দমাতে নির্বিচারে গুলি চালিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি শেখ হাসিনার। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে তিনি ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে উড়াল দেন। এর আগেই দেশজুড়ে কোটি মানুষ পথে নেমে বিজয় উল্লাসে মাতেন; নেন গণভবনের দখল। আবু সাঈদের আত্মত্যাগের পথ ধরে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, মজুরসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ শাসকের বন্দুকের নলের সামনে বুকে পেতে দাঁড়ানোর নজিরবিহীন সাহস দেখান। বিরলতম এ আত্মত্যাগে বিজয়ী হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। উল্লাসে মাতোয়ারা সাধারণ মানুষ জানিয়েছেন, জনজোয়ারে ভেসে গেছে ক্ষমতার দম্ভ।
কোটা বাতিলে উত্তাল ছিল দেশ : সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন গত ৫ জুন হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করলে অসন্তোষের শুরু হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গত ১ জুলাই থেকে শুরু হয় আন্দোলন। তৎকালীন সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিলেও কৌশলে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফেরত আনার চেষ্টা করছে অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা সরব হন। ওই বছরের ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ আখ্যা দেন বলে দাবি করা হয়। এতে ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্লোগান ওঠে, ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’। এ স্লোগানের জবাব দিতে ছাত্রলীগ প্রস্তুত পরের দিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ কথা বলার এক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর তাণ্ডব চালানো হয়।
ছাত্রলীগের বহিরাগত নেতাকর্মী ছাত্রীদের মেরে রক্তাক্ত করে। এতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। গত ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ বুক পেতে দাঁড়ালে, নিরস্ত্র এ তরুণকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ১৮ থেকে ২১ জুলাই নারকীয় বর্বরতা চলে বিক্ষোভকারীর ওপর। প্রায় দুই হাজার মানুষ মারা যায়, হাজার হাজার মানুষ গুলিবিদ্ধ হন। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তঝরা দিন ছিল ৫ আগস্ট। সেদিন শতাধিক প্রাণ ঝরলেও ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে লাখো ছাত্র-জনতা রাজধানীর প্রবেশপথে অবস্থা নেন। শেষ সময়েও বিক্ষোভ দমনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে শেখ হাসিনা। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনে টিকতে পারেনি, সর্বশেষ কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইতি টানতে হয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হেলিকপ্টারে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। এর মাধ্যমে তার স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। তিনি পালিয়ে যাওয়ার পরপরই গণভবনে ঢোকেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। আনন্দ-উল্লাসে জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উদ্যাপন করেন দেশের মানুষ।
জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি টেনে তোলার চেষ্টা চলছে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা, আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুম-খুন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধের দ্রুত উপযুক্ত বিচার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এরইমধ্যে প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে। যেসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে তৈরি করা হবে একটি জুলাই সনদ। এটিই ‘জুলাই জাতীয় সনদ’।
রাষ্ট্রপতির বাণী : গতকাল সোমবার ৫ আগস্ট ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’কে ফ্যাসিবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের দিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এই ঐতিহাসিক দিনে স্বৈরাচার ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধ চূড়ান্ত সফলতা পেয়েছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য।
এই চেতনা বাস্তবায়ন করেই আমরা সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারব।’ তিনি শহিদদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে বলেন, তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ আজ নতুন পথে এগোচ্ছে। পাশাপাশি আহত ও পঙ্গু বীর যোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব।’ রাষ্ট্রপতি আশা প্রকাশ করেন, গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে চলমান রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রক্রিয়া একটি ন্যায্য ও সাম্যভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথ প্রশস্ত করবে। সবশেষে তিনি ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’-এর সব কর্মসূচির সফলতা কামনা করেন।
৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বাণীতে বলেছেন, ‘জুলাই আমাদের নতুন করে আশার আলো- একটি ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। হাজারো শহিদের আত্মত্যাগ আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। পতিত স্বৈরাচার ও তার স্বার্থলোভী গোষ্ঠী এখনও দেশকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হবে। আসুন সবাই মিলে আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে আর কোনো স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না।’ গণঅভ্যুত্থান দিবসের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন আজ (৫ আগস্ট)। এক বছর আগে এই দিনে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পূর্ণতা পায়, দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয় প্রিয় স্বদেশ।
বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, যাদের মুখবন্ধ আন্দোলনের ফসল আমাদের এই ঐতিহাসিক অর্জন, তাদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই প্রধান উপদেষ্টা। ফ্যাসিবাদী শক্তিকে মোকাবিলা করতে গিয়ে যারা শাহাদাত বরণ করেছেন, জাতি তাদের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।’ গণঅভ্যুত্থানে শাহাদাত বরণকারী সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।