
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত হওয়া ছয় লাশের পরিচয় এক বছরেও শনাক্ত করতে না পেরে অবশেষে লাশগুলো দাফন করেছে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা মেডিকেল থেকে লাশ বুঝে নিয়ে দুপুরে রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে দাফন করেছে সংস্থাটি। শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মনসুর বলেন, আদালতের নির্দেশের পর লাশগুলো গতকাল সকালে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা দাফন করেছে। তিনি বলেন, লাশগুলো এক বছরের বেশি সময় ধরে মর্গে ছিল। এ সময় অনেকেই শনাক্ত করতে এসেছেন। কয়েকজনের ডিএনএ নমুনা নিয়েও পরীক্ষা করা হয়েছে, তবে শনাক্ত করা যায়নি। লাশের দাবিদার যারা এসেছিলেন তাদের সঙ্গে কারও মেলেনি।
আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের দাফন সেবা কর্মকর্তা কামরুল আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, গতকাল (বৃহস্পতিবার) সকালে ওই ছয়টি লাশ আমরা পেয়েছি। দুপুর ২টার দিকে তাদের জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। শাহবাগ থানার তথ্য বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ীসহ কয়েকটি এলাকা থেকে এসব লাশ আসে। ময়নাতদন্ত অনুযায়ী, তাদের বেশির ভাগের মৃত্যু হয়েছে ‘আঘাতজনিত কারণে’।
এদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর রামপুরায় একটি ভবনের কার্নিশে ঝুলে থাকা একছাত্রকে গুলি এবং ওই এলাকায় আরও দু’জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ফারুক আহমেদ ও সাইমুম রেজা তালুকদার আনুষ্ঠানিক অভিযোগটি ট্র্যাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার বরাবর দাখিল করেন। এখান থেকে আজ এই অভিযোগটি বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিম সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ উপস্থাপন করা হয়। মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)’র সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আমির হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী জুমার নামাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন। এসময় তিনি রামপুরা এলাকায় তার বাসার কাছাকাছি পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে পড়ে যান। এ সময় পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করে। প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে গিয়ে আমির আশ্রয় নেন একটি নির্মাণাধীন ভবনের চারতলায়। তার ভাষ্য অনুযায়ী, বিক্ষোভকারীদের পিছু নিতে পুলিশও ওই ভবনের চারতলায় উঠে যায়। পুলিশ সদস্যরা তার দিকে অস্ত্র তাক করে বারবার নিচে লাফ দিতে বলেন। এক পুলিশ সদস্য তাকে ভয় দেখাতে কয়েক রাউন্ড গুলিও করেন। একপর্যায়ে ভয়ে আমির লাফ দিয়ে ভবনের রড ধরে ঝুলে পড়েন। ঠিক তখনই তৃতীয় তলা থেকে এক পুলিশ সদস্য তার পায়ে ছয়টি গুলি করেন। এরপর পুলিশ চলে গেলে দুই পা রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি ঝাঁপ দিয়ে কোনোরকমে তৃতীয় তলায় পড়েন।
ঘটনার প্রায় তিন ঘণ্টা পর এক শিক্ষার্থী ও দু’জন চিকিৎসক তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় এক হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। রামপুরায় ওই একই দিনে ঘটনাস্থলের কাছেই আরও দু’জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
এ ঘটনায় কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করার অভিযোগে এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারকে গত ২৮ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এর দুই দিন আগে, ২৬ জানুয়ারি রাতে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থানা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)’র একটি টিম।
এদিকে, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে সাভারের আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানি শুরু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ প্রসিকিউসনের পক্ষে শুনানি করছেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এমএইচ তামিম। এদিকে অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানির জন্য আসামিপক্ষকে তিন দিন সময় দেওয়া হয়েছে। গত ২ জুলাই এই মামলায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এই ১৬ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার ৮ জনকে আজ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। তারা হলেন- ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, এসআই মালেক, এসআই আরাফাত উদ্দিন, এএসআই কামরুল হাসান, আফজাল হোসেন ও কনস্টেবল মুকুল।
আশুলিয়া লাশ পোড়ানোর নৃশংস ঘটনায় করা মামলার পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছয় তরুণকে গুলি করে হত্যার পর লাশগুলোকে পুলিশ ভ্যানে রেখে আগুন লাগিয়ে দেন পুলিশ সদস্যরা। যখন এসব লাশে আগুন দেওয়া হচ্ছিল, তখন একজন জীবিত থাকা অবস্থায় তার গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়।’
নৃশংস এ ঘটনায় গত ১১ সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়।