
স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-নির্যাতনে দীর্ঘদিন কোণঠাসা ছিল বিএনপি। মামলা হামলায় জর্জরিত ছিল দলটির নেতাকর্মীরা। মামলা-হামলার ভয়ে অধিকাংশ নেতাকর্মী ঘরে থাকতে পারেনি। হাজার হাজার নেতাকর্মী ছিল কারাগারে। গত বছরের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে সারা দেশে চাঁদাবাজির এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল লীগের নেতাকর্মীরা। হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীরা ব্যাকফুটে চলে যায়। কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, কেউ কেউ গাঁ ঢাকা দিয়েছে, আবার কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। সেই সুযোগে লীগের চাঁদাবাজির সাম্রাজ্যে হানা দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর। ঘটছে দখল, চাঁদাবাজি, সংঘাতসহ খুনের মতো ঘটনাও। এসব অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে দল থেকে অনেক নেতাকর্মীকে বহিষ্কারও করছে বিএনপি। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ গ্রেপ্তার হচ্ছে।
সম্প্রতি মিটফোর্ডে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বিপাকে পরে বিএনপি। এছাড়াও প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে দলটি। যদিও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের হাইকমান্ড থেকে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিও গ্রহণ করেছে দলটি। কেউ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকলে দলের পক্ষ থেকে কোনো রকম প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না। কারও বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি এবং এর অঙ্গসংগঠনের ৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে দলটি। তবুও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না দলটির নেতাকর্মীদের। সামনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের আগে চাঁদাবাজি ইস্যুতে অনেকটা দুশ্চিন্তায় বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের পতনের পর দেশজুড়ে দলটির নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে একেবারেই ব্যর্থ হচ্ছে বিএনপি। বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন হলে আগামীতে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। সেক্ষেত্রে দখল-চাঁদাবাজির মতো অপরাধের নানা অভিযোগ দলটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। যদিও বিএনপির হাইকমান্ড থেকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে বলেও দাবি করা হচ্ছে।
সূত্রমতে, সরকারি বা প্রশাসনিক মদদ কিংবা রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়া ছাড়া চাঁদাবাজি সম্ভব নয়। আওয়ামী শাসনামলে শাসক দল, সরকার ও প্রশাসনের মিলিত মদদে ক্ষমতাসীনদের অনুগ্রহভাজনরা চাঁদাবাজি চালিয়েছে। এখন সরকারি ও প্রশাসনিক মদদ ক্ষীণ হয়ে এলেও রাজনৈতিক ছত্রছায়াকে ব্যবহার করে দুর্বার গতিতে প্রায় সবখানে চলছে চাঁদাবাজি। রাজনৈতিক দলগুলো চাঁদাবাজির অভিযোগের ব্যাপারে এক অপরের উপর অভিযোগ করলেও এই অপরাধের জন্য প্রায় সকল দলই কমবেশি দায়ী। প্রথমেই আসে বর্তমানের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির কথা। বিএনপির প্রতি জনগণের প্রত্যাশা অনেক। আওয়ামী লীগ যা করেছে, জনগণ বিএনপির নেতাকর্মীদের থেকে তা প্রত্যাশা করে না। কিন্তু গুটিকয়েক সুবিধাবাদী বিপথগামীর দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ নানা ধরনের অপকর্মের অভিযোগ বিএনপির ঘাড়ে জোরালোভাবে চেপে ধরেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির একশ্রেণির নেতাকর্মী চাঁদা দাবি ও দখলসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা, দ্রুত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও কোনোকিছুতেই থামানো যাচ্ছে না দলের একশ্রেণির বেপরোয়া নেতাকর্মীকে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের হুঁশিয়ারি ও সাংগঠনিক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে দল ও অঙ্গসংগঠনের কিছু নেতাকর্মীর অপকর্ম অব্যাহত রয়েছে। এসব কারণে সারা দেশে সমালোচনা, জনমনে ক্ষোভ ও হতাশার কারণে প্রচণ্ড চাপে পড়েছে বিএনপি। এতে দুশ্চিন্তায় দলটির হাইকমান্ড।
এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রকৃত অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর আইনি পদক্ষেপ দেখতে চায় বিএনপি। দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা বলছেন, যে অন্যায় করে, সে মূলত অপরাধী। সে দলের নেতাকর্মী হোক বা অন্য কেউ। দলের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, তাতে কিছু আসে যায় না। অন্যায়-অপকর্ম যে করবে, তার বিচার হতে হবে আইনের ভিত্তিতে। কেউ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকলে বিএনপির পক্ষ থেকে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যা অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানান তারা। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে অপরাধীদের ধরতে সরকারের ‘চিরুনি অভিযান’কে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনকে সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত আছে দলটি। তবে এ অভিযান যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কিংবা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে না হয়, ‘প্রকৃত’ অপরাধীরা যেন ধরা পড়ে, তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি।
সূত্রমতে, মূল দল বিএনপি থেকে শুরু করে প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন শৃঙ্খলা রক্ষায় দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। কারণ হিসেবে দলটির দায়িত্বশীলরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে সারা দেশে বিএনপির কিছু উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মী নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হয়। ফলে দেশে-বিদেশে বিএনপির ইমেজ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও ইমেজ নষ্টকারীদের বিরুদ্ধে বিএনপি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। সূত্রমতে, আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে দলটি এখন বিভিন্ন পদ থেকে দুর্বৃত্তদের অপসারণে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেছে। জানা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাত বাড়ছে। এর সঙ্গে টেন্ডার ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার প্রতিযোগিতা নিয়েও দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে।
এদিকে আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন ইস্যুতে বর্তমানে কয়েকটি দল এবং গোষ্ঠী বিএনপিকে চাপে ফেলার চেষ্টা চলছে বলে মনে করছে বিএনপি। নেতারা বলছেন, শুরু থেকেই যেকোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে তারা অত্যন্ত সোচ্চার। কিন্তু বিএনপিকে ঘায়েল কিংবা বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট- সর্বোপরি সামগ্রিক পরিস্থিতিকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার পাশাপাশি নির্বাচন বিলম্বিত করতেই একটি মহল এসব ইস্যু নিয়ে মাঠে নেমেছে।
বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিব বলেছেন, ‘নিজেদের চাঁদাবাজি আড়াল করতে বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে একটি নয়া দল। স্বাধীনতাবিরোধী ও বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে আগ্রহী আরও দুটি দল নতুন দলটিকে সঙ্গে নিয়ে তারেক রহমান ও বিএনপির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। তারা সংঘাত সৃষ্টির উস্কানি দিচ্ছে।’
চাঁদাবাজির অভিযোগকে নির্বাচনের সময় বিএনপির বিরুদ্ধে মাঠে যাতে কাজে লাগানো যায়, তার পরিকল্পনা নিয়ে এনসিপি আর জামায়াত যে তৎপর তা বিএনপির অনেকেই মনে করেন। তারা বলেন, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে এনসিপি ভাবছে তারাই হবে বিকল্প আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে আটকাতে চাঁদাবাজি ইস্যুতে এনসিপি আর জামায়াত একযোগে বিরামহীন বক্তব্য দিচ্ছে।
সূত্রমতে, বাংলাদেশে সহিংসতা ও চাঁদাবাজির কারণে জনজীবন অস্থির হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক কোন্দল, চাঁদাবাজি, সংঘর্ষে একের পর এক প্রাণহানিও ঘটছে। তা রোধে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমতাবস্থায়, অন্তর্বর্তী সরকার কেন চাঁদাবাজদের প্রতি কঠোর হচ্ছে না- এ প্রশ্নও রয়েছে বিএনপি নেতাদের। জামায়াত এবং এনসিপি নেতাকর্মীরা নানা অপকর্ম করলেও, তা প্রচার হচ্ছে না বলে অভিযোগ তাদের। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, ‘দল দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়স্থল হতে পারে না। চাঁদাবাজ ও উচ্ছৃঙ্খল নেতাদের কোনো ছাড় নেই। প্রয়োজনে প্রকাশ্যে বহিষ্কার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হবে।’
সম্প্রতি তারেক রহমান সরকারের ভূমিকা নিয়ে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘দেশের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিল, সেই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আমরা স্বৈরাচারকে বিতাড়িত করেছি। কিন্তু আমরা বিজয় অর্জন করলেও ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে বারবার বলেছি, অন্যায়কারী যেই হোক, আমরা প্রশ্রয় দেব না। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সরকার কেন ব্যর্থ হচ্ছে? এই সরকারের কাছে আমাদের সবার প্রশ্ন, তারা কেন প্রশ্রয় দিচ্ছে, আশ্রয় দিচ্ছে?’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে বিভিন্ন জেলায় সংগঠনের গঠনমূলক কাজের পাশাপাশি শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এরইমধ্যে প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শৃঙ্খলা ও নীতিগত কঠোরতার বার্তা দিয়ে বিএনপি ভবিষ্যতের আন্দোলন ও দল গঠনে আরও সুসংগঠিত হতে চায় বলে মন্তব্য করেন বিএনপির এই নেতা। বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘বিএনপিকে বিতর্কিত করতেই একটি দলের ইন্ধনে আমাদের দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অথচ ওই দলটিই অনেক ব্যাংক দখল করেছে, কোচিং সেন্টার দখল করেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখল করেছে। এসব নিয়ে তাদের উচ্চবাচ্য নেই। এতেই বোঝা যায়, এরা কী চায়। বিএনপির মধ্যে অনেককে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই দলটি যেমন ছদ্মবেশ ধরে ঘাপটি মেরে থাকে, তেমনি অপকর্মও করে ছদ্মবেশে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা বলেন, একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী থাকে, তারা সব সরকারের সময়ে সুবিধা নেয়।
আমরা এখনও সরকারে আসিনি; কিন্তু অনেকেই এতদিন যারা আঁতাত করে চলেছে, হঠাৎ করে তারা বিপ্লবী হয়ে গেছে, তারা সব এখন বিএনপি হয়ে গেছে। এই গোষ্ঠীটা আমাদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। আমরা সেগুলোকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।