
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) একাডেমিক ও হল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। গত শুক্রবার রাতে বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নিয়ে স্লোগান দেন ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর, হল পলিটিক্স নো মোর’। বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলপাড়া থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসিতে এসে জড়ো হয় শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভে শেখ মুজিবুর রহমান হল, মুহসীন হল, বিজয় ৭১ হল, এএফ রহমান হলসহ বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। রোকেয়া হলের ছাত্রীরা গেটের তালা ভেঙে বাইরে বের হয়ে এসে বিক্ষোভ করেন।
শিক্ষার্থীদের মতে, সহাবস্থানের রাজনীতি ছেড়ে ছাত্রসংগঠনগুলো দ্বন্দ্বের পথেই হাঁটে। যতটা না একে-অন্যের প্রতি সহমর্মিতা থাকবে, তার থেকে বেশি বিদ্বেষ পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং হল কমিটির নামে ঢাবিতে আর ‘দখলদারিত্বের’ রাজনীতি চলবে না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার দিবাগত রাত ২টার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে। এসময় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ঢাবি উপাচার্য বলেন, ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সেটিই বহাল থাকবে এবং প্রত্যেক হল প্রশাসন এই নীতিমালার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
ছাত্রদলের সদ্য ঘোষিত হল কমিটি নিয়ে সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার আশ্বাস দেন উপাচার্য। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে হল পলিটিক্সের সম্পূর্ণ অবসান দাবি করেন। একইসঙ্গে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছাত্রদল, শিবির, বাগছাস, বামসহ হলে এক্সিসটিং গুপ্ত কমিটি বিলুপ্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল একাডেমিক এরিয়ায় রাজনীতির সব কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে ছাত্ররাজনীতির পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দিতে হবে। হল প্রভোস্টদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে। দ্রুত ডাকসু বাস্তবায়ন করতে হবে।
কঠোর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি উমামার : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্রদলের কমিটি স্থগিত না হলে কঠোর পদক্ষেপ নেবেন বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। ঢাবির হলে ছাত্রদলের নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণাকে ‘জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে বেঈমানি’ আখ্যা দিয়েছেন তিনি। গত শুক্রবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি ফেসবুকে লিখেন, ১৭ জুলাই, ২০২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিবাদে হলের প্রশাসনিক ভবনের সামনে আমিসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রতিবাদমূলক অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছি। গতবছর ১৬ জুলাই আবু সাঈদ শহিদ হওয়ার মাধ্যমে ছাত্ররা ক্যাম্পাস ছাত্রলীগমুক্ত করার সাহস পায়। কিন্তু বছর না ঘুরতেই গুপ্ত রাজনীতি ও প্রকাশ্য কমিটির চর্চা শুরু হয়েছে। যা স্পষ্টত জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে বেঈমানি। আজকে (শুক্রবার) রাতের মধ্যে কমিটি স্থগিত না হলে শিক্ষার্থীরা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে হুঁশিয়ারি দেন উমামা ফাতেমা।
অন্যদিকে ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখার সভাপতি এসএম ফরহাদ প্রশ্ন তুলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর হলভিত্তিক কমিটি নিয়ে আগে কোনো আপত্তি ওঠেনি, অথচ বর্তমানে অন্য দলের কমিটি নিয়ে বিরোধিতা করা হচ্ছে। গতকাল শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘শিবির দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, হলে রাজনীতি না হোক। আমরা চাই, হলের বাইরে শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় রাজনীতি করুক। অথচ বাম সংগঠনগুলো হলে কমিটি গঠন করলেও কেউ প্রশ্ন তোলে না, এখন কেন?’ তিনি দাবি করেন, শিবির হল এলাকায় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি চালায় না।
‘হলে আমাদের কোনো দলীয় কর্মসূচি নেই। আমরা শিক্ষার্থীদের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করি,’ বলেন তিনি। ফরহাদ আরও বলেন, ‘কেউ বাইরে থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা মনগড়া প্রস্তাবনা দিয়ে শিবিরকে দিক নির্ধারণ করতে পারে না। শিবির চলে নিজস্ব দলীয় নীতির ভিত্তিতে।’
ঢাবির হলে প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ। গত বছরের ১৭ জুলাইয়ের পরিপত্র অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। গত শুক্রবার মধ্যরাতে ঢাবির হলগুলোতে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার প্রতিবাদে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের তিনি এ কথা জানান।
গত শুক্রবার সকালে ঢাবির ১৮টি হলে ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর ওই কমিটি নিয়ে নানা সমালোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এর প্রতিবাদে ও হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে মধ্যরাতে ছাত্রদের বিভিন্ন হল থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। একপর্যায়ে রোকেয়া হল ও শামসুন নাহার হলের ছাত্রীরা ফটকের তালা ভেঙে বের হয়ে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেন।
গত শুক্রবার দিবাগত রাত একটার দিকে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। রাত দুইটার দিকে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান ও প্রক্টর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে বাসভবনের সামনে আসেন। এ সময় তাদের সঙ্গে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের প্রায় এক ঘণ্টা আলাপ-আলোচনা হয়। পরে উপাচার্য বলেন, ‘হল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই হল প্রভোস্টের নেওয়া সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।’ পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, ‘হল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রিত থাকবে।’ উপাচার্যের ওই বক্তব্যে শিক্ষার্থীরা ‘না, না’ বলে আপত্তি জানান ও হলগুলোতে সম্পূর্ণভাবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করেন। তারা হলে হলে শিবিরের গুপ্ত কমিটির প্রকাশ্য ও ছাত্রদল কমিটির সদস্যদের শাস্তির দাবিও জানান। শেষ পর্যন্ত প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে। এ ঘোষণার পর শিক্ষার্থীরা হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন ও স্লোগান দেন, ‘এই মুহূর্তে খবর এল, হল পলিটিকস নিষিদ্ধ হলো।’ পরে রাত ৩টার দিকে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ হলে ফিরে যান।