
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গতকাল রোববার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এবারের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধানের পাশাপাশি বিগত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারমূলক উদ্যোগ, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা এবং ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের দৃঢ় অঙ্গীকার বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরবেন প্রধান উপদেষ্টা।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সফর সঙ্গী হয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির এবং এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে চারজন রাজনৈতিক নেতার সফর ঘিরে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক সংকটের আলোচনায় ‘আন্তর্জাতিক অ্যাক্টররা’ উপস্থিত থাকতে পারেন। কেননা, বাংলাদেশের নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক সংকট নিয়ে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ত হওয়ার ঘটনা অতীতে ঘটেছে। এই সফরে নির্বাচনের আগে রাজনীতির অনেক জট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে আলোকপাত করা হতে পারে। বিশেষ করে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ কেমন হবে, এর রূপরেখায় রাজনীতিকদেরও সঙ্গে রাখতে চাইছেন ইউনূস। এতে বর্তমান অনিশ্চিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একধরনের মধ্যস্থতার ভূমিকা নিতে পারে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, প্রধান উপদেষ্টা বিগত এক বছরে দেশে সংঘটিত সংস্কার এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বিশ্ব নেতাদের সামনে তুলে ধরবেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাতিসংঘে সফরসঙ্গী হওয়ার ব্যাপারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি নিরপেক্ষতা দেখানোর চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি সেখানে তিনি এই রাজনীতি দেখাতে চান যে, ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে কাজটি করছি’। এছাড়াও দুটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। প্রবাসীদের সঙ্গে মিটিং আছে, তিনি সম্ভবত সেখানে চাচ্ছেন আমাদের।’ সফর শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের প্রথম দিকে দেশে ফিরবেন বলেও জানান মির্জা ফখরুল।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। সেই দ্বন্দ্ব কীভাবে সমাধানের দিকে নেওয়া সম্ভব বিদেশিদের সামনে রাজনীতিকদের সরাসরি হাজির করে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ খোঁজতে পারেন। স্পষ্টত মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্র মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
এব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক নেতাদের সফরসঙ্গী হিসাবে সঙ্গে নেওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক চিন্তা আছে। এটা অত্যন্ত স্পষ্ট। রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠাই লক্ষ্য। এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার কোনো বিষয় থাকতে পারে। তিন দলকে বুঝিয়ে যদি নির্বাচনের দিকে একমত করতে পারেন, অসুবিধা কী।’
এবার উচ্চপর্যায়ের সভার মধ্য দিয়ে ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশন শুরু হবে। সেই অধিবেশনে যোগ দিতে গতকাল ঢাকা ত্যাগ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। তার সফরসূচি অনুযায়ী, আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেবেন তিনি। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টা একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেবেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বৈশ্বিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এ বছরের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতির সভাপতিত্বে ‘হাই লেভেল কনফারেন্স অন দ্য সিচুয়েশন অব রোহিঙ্গা মুসলিমস অ্যান্ড আদার মাইনোরিটিস ইন মিয়ানমার’ শীর্ষক একটি উচ্চ পর্যায়ের সভা হবে। রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এমন একটি উচ্চপর্যায়ের সভার আয়োজন এবারই প্রথম। এই উচ্চ পর্যায়ের সভা থেকে যেন রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধানের একটি কার্যকর পরিকল্পনা উঠে আসে, সে জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদার ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে গত মাসে কক্সবাজারে একটি অংশীদার সভা অনুষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক ইউনূস গতবছর জাতিসংঘে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন- তার প্রেক্ষিতে এবার এই সম্মেলন হতে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্মেলন আয়োজনের জন্য প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া প্রস্তাব সদস্য রাষ্ট্রগুলো সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থন দেয়।
এছাড়া, প্রধান উপদেষ্টা ২৫ সেপ্টেম্বর যুবকদের জন্য কর্মপরিকল্পনার ৩০তম বার্ষিকী উপলক্ষে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও অংশ নেবেন। বাংলাদেশ শান্তি ও নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার আলোচনায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং শান্তিরক্ষী রাষ্ট্র হিসেবে দেশের অবদান তুলে ধরবে। অধ্যাপক ইউনূস তার ভাষণে বিশ্বের নানা জরুরি ইস্যুও তুলে ধরবেন। এর মধ্যে রয়েছে-শান্তিরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন ও জলবায়ু ন্যায়বিচার, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, অবৈধ অর্থপাচার, নিরাপদ অভিবাসন ও অভিবাসী অধিকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে টেকসই প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতি ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা।
সফরকালে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিব ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনও একাধিক বহুপাক্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। এর মধ্যে রয়েছে-কমনওয়েলথ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সভা, পিসবিল্ডিং কমিশন মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠক, ‘জি-৭৭ ও চীন’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক, নারী-শান্তি ও নিরাপত্তা ফোকাল পয়েন্ট নেটওয়ার্ক, ওআইসি বার্ষিক সমন্বয় সভা, বিমসটেক, সিকা এবং এলডিসি মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠক। এ ছাড়া আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতির সভাপতিত্বে ‘হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য সিচুয়েশন অব রোহিঙ্গা মুসলিমস অ্যান্ড আদার মাইনোরিটিজ ইন মিয়ানমার’ শীর্ষক এক উচ্চপর্যায়ের সভায়ও অংশ নেবেন। প্রধান উপদেষ্টা ২ অক্টোবর দেশে ফিরবেন।