
খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা ওই কিশোরীর শারীরিক পরীক্ষার পর প্রতিবেদন জেলা সিভিল সার্জনের কাছে জমা দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড। সেখানে ওই কিশোরীকে ধর্ষণের আলামত মেলেনি। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন ছাবের আহম্মেদের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এ ঘটনার চার দিন পর গতকাল বুধবার থেকে খাগড়াছড়িতে স্বস্তি ফিরেছে। সকাল থেকে জেলা সদর ও শহরতলীতে সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল করেছে। খুলেছে দোকানপাট।
সূত্রে জানা গেছে, সিভিল সার্জনের কাছে জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদনে ধর্ষণের পরীক্ষার ১০টি সূচকের সব কটিতে স্বাভাবিক লেখা রয়েছে। এর অর্থ ধর্ষণের কোনো আলামত নেই। ধর্ষণের আলামত পরীক্ষায় তিন চিকিৎসক দলের নেতৃত্ব দেন খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ জয়া চাকমা। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন, নাহিদা আকতারসহ আমরা তিনজন এ কমিটিতে ছিলাম। প্রতিবেদনটি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জমা দিয়েছি। প্রতিবেদনে কী রয়েছে, বিষয়টি ওনারা জানাবেন।’
জেলা সিভিল সার্জন ছাবের আহম্মেদ বলেন, ‘কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর এ ঘটনায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের দেওয়া প্রতিবেদনে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। তারপরও এটি আদালতের বিষয়। আদালত সত্য-মিথ্যা যাচাই করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল রাতেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়েছে।’ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আরেফিন জুয়েল প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জুম্ম ছাত্র-জনতার মুখপাত্র কৃপায়ন ত্রিপুরা বলেন, ‘এটি সরকারের একটি পরিকল্পিত মনগড়া প্রতিবেদন, আপনারা দেখলেই বুঝতে পারবেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণের পরীক্ষার প্রতিবেদন এত দ্রুত কখনো দেওয়া হয়েছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। আর বিভিন্নজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে ভুক্তভোগী কিশোরীর ছবি দিচ্ছেন, এটিও একটি অপরাধ। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি খেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজনেরা। রাতেই তাকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন বুধবার সে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায়। এ ঘটনায় শয়ন শীল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর এর প্রতিবাদে জুম্ম ছাত্র-জনতার ব্যানারে গত শনিবার খাগড়াছড়িতে অবরোধ ডাকা হয়। পরদিন থেকে তিন পার্বত্য জেলায় অবরোধের ডাক দেয় সংগঠনটি। অবরোধের মধ্যেই গত রোববার বিক্ষোভ ও সহিংসতায় রণক্ষেত্র পরিণত হয় খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজার। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ছিল স্থানীয় একটি পক্ষ।
এ সময় গুলিতে তিনজনের মৃত্যু হয়। তারা তিনজনই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর। সেনাবাহিনীর মেজরসহ আহত হন অন্তত ২০ জন। রামেসু বাজার এলাকায় আগুন দেওয়া হয় প্রায় অর্ধশত বসতবাড়ি ও ৪০টির মতো দোকানে।
চার দিন পর স্বস্তি ফিরছে খাগড়াছড়িতে : টানা চার দিনের অবরোধের পর খাগড়াছড়িতে যানবাহন চলাচল করেছে। খুলেছে দোকানপাট। জুম্ম ছাত্র-জনতা নামের একটি সংগঠন স্কুলছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ তুলে অনির্দিষ্টকালের সড়ক অবরোধের ডাক দিয়েছিল। তবে শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রতি সম্মান জানিয়ে এবং প্রশাসনের ৮ দফা দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাসের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে সংগঠনের ফেসবুক পেজে দেওয়া ঘোষণায় অবরোধ আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত স্থগিত করা হয়।
অবরোধ স্থগিত হলেও এখনও জনমনে আতঙ্ক রয়ে গেছে। জেলা প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা বহাল রয়েছে। খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সেনা টহল, বিজিবি ও পুলিশের অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় আছে।
এদিকে, সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন ডা. ছাবের জানিয়েছেন, ধর্ষণের ঘটনায় মেডিকেল রিপোর্ট পুলিশের মাধ্যমে আদালতে উপস্থাপন করা হবে।
অবরোধ চলাকালে গত ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সহিংসতায় ৩ জন নিহত এবং অনেকে আহত হন। গুইমারার রামসু বাজারসহ একাধিক দোকানপাট, বসতবাড়ি ও অফিসে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল বাতেন মৃধা বলেন, ধীরে ধীরে জনজীবন স্বাভাবিক হয়েছে। যানবাহন চলাচল শুরু করেছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।