
চলমান রাজনৈতিক সংকটের প্রধান বিষয়গুলো হচ্ছে- জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি, গণভোটের সময় নির্ধারণ ও সংস্কার প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট বাদ দেওয়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তরের পর এই ইস্যুগুলো সামনে আসে। এ নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে সরকার গত ৩ নভেম্বর দলগুলোকে আহ্বান জানায় শিগগির একটি অভিন্ন সিদ্ধান্ত জানাতে এবং সম্ভব হলে সেটা যেন সাত দিনের মধ্যে হয়। ওই দিন উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা কোনো আলটিমেটাম দেইনি, আহ্বান জানিয়েছি। আমরা অপেক্ষা করব, তারপর অবশ্যই সরকার সরকারের মতো কাজ করবে।’ সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও জোটগতভাবে বৈঠক করলেও শেষ পর্যন্ত কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। বরং সরকারের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপের পর প্রণীত জুলাই সনদ নিয়ে নতুন করে দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার আহ্বানকে ভালোভাবে নেয়নি কয়েকটি দল। ফলে সমঝোতা তো দূরের কথা, উল্টো বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে প্রকাশ্যে বিরোধ বেড়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দুই দলই গণভোটের পক্ষে থাকলেও বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট চায়। এ ছাড়া তাদের দাবি, সনদের যে বিষয়ে তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলো গণভোটের প্রস্তাবে উল্লেখ থাকতে হবে এবং দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চায় জামায়াত। তাদের দাবি, গণভোটের প্রস্তাবে কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট থাকতে পারবে না। এই দাবিতে তারা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। এনসিপি নোট অব ডিসেন্ট না থাকার পক্ষে থাকলেও আন্দোলনে নেই।
এদিকে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে নির্দেশনা দিতে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের এক সপ্তাহের সময় শেষ হয়েছে গতকাল সোমবার। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা মেলেনি। বরং সনদ বাস্তবায়নে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ বেড়েছে। এই অবস্থায় সরকার চলমান সংকট নিরসনে দ্রুতই রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আবারও আলোচনায় বসতে পারে। এ ছাড়া আইন মন্ত্রণালয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারির প্রস্তুতিমূলক কাজ চলছে এবং আদেশের খসড়া আগামী বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উত্থাপন করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী- দুই দলই উল্টো এ সংকটের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও সরকারকে দায়ী করেছে। উভয় দলই সংশয় প্রকাশ করে বলছে যে, সরকার হয়তো ‘কোনো বিশেষ দল’কে সুবিধা দিতে এটি করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে কেউ কেউ বলছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর নেওয়া সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে না আনা এবং এ নিয়ে তৈরি হওয়া সংকট দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পেছনে নির্বাচন প্রলম্বিত করার একটি চেষ্টাও থাকতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে মতৈক্যে পৌঁছাতে না পারায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকার নিজ থেকেই একটি ‘সিদ্ধান্ত নেবে’ বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, সরকার দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দিয়েছে। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত আসেনি। তারা যেহেতু সাত দিনের মধ্যে আলোচনায় বসেনি, সেক্ষেত্রে সরকার একটা সিদ্ধান্ত নেবে। আমি তো কাউকে বলতে শুনিনি যে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারের এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ‘এখতিয়ার রয়েছে’ জানিয়ে এই উপদেষ্টা বলেন, সরকার চায় ১০০ ভাগ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভেতর দিয়ে আসুক। যদি ৯০ ভাগও আসে, ১০ ভাগ না আসে, সেক্ষেত্রে সরকারের নিজস্ব একটা দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে অচলাবস্থাকে কাটিয়ে আনতে হবে। আর খুব বেশি দিন দেরি হবে না। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশি সময় নষ্ট করা যাবে না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সাধারণ মানুষ পিআর বোঝে না। বিদেশ থেকে কিছু পন্ডিত এসে কমিশন করে সাধারণ মানুষ বোঝে না এমন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে। সরকার জুলাই সনদ নিয়ে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। বিএনপির মহাসচিব বলেন, বৃষ্টির মাঝে ছাতা হাতে সংসদ ভবনে গিয়ে স্বাক্ষরও করেছি। কিন্তু স্বাক্ষরের পর আমাদের প্রস্তাবগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে। এটা জাতির সঙ্গে প্রতারণা।
এদিকে আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি দ্রুত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি, চলতি মাসে গণভোটের আয়োজনসহ পাঁচ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে জামায়াতসহ আটটি ইসলামী দল। তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, ১০ নভেম্বরের মধ্যে দাবিগুলো পূরণ না হলে ১১ নভেম্বর (আজ মঙ্গলবার) ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে এবং সেখান থেকে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবে। এই কর্মসূচিকে ভালোভাবে নিচ্ছে না বিএনপি এবং গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্য দলগুলো। তারা এই কর্মসূচি জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র বলে আশঙ্কা করছে।
গত রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ জানান, ‘গত ২৫ অক্টোবর আন্দোলনরত আট দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এক বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার ধারাবাহিকতায় গত ৬ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। সেখানে আমাদের দাবি ও এর যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি।’ আরও বলা হয়, ‘আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম আমাদের দাবির গুরুত্ব অনুধাবণ করে প্রধান উপদেষ্টা কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু আমাদের হতাশ হতে হয়েছে। তাই আমাদের পুর্বঘোষিত কর্মসূচি মাঠেই প্রতিফলিত হবে ইনশাআল্লাহ।’
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সরকারকে দাবি বাস্তবায়নে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। আলটিমেটাম কারা দিচ্ছে সরকারকে? সরকার তো আপনাদের (জামায়াত) পক্ষে সুপারিশ দিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তো আপনারা যা চান, তাই দিয়েছে। সে জন্য আপনারা তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলছেন। আপনারা যা শুরু করেছেন তাতে করে উৎসাহিত হবে পতিত ফ্যাসিস্ট। তাতে উৎসাহিত হবে বাংলাদেশে অন্য যেকোনো রকমের অগণতান্ত্রিক শক্তি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজপথের এই ময়দানকে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আর উত্তপ্ত হতে দেব না। গণভোটের মধ্য দিয়ে আইন প্রণীত হয়ে যাবে, এই গণভোটের মধ্য দিয়ে সংবিধান পরিবর্তিত হয়ে যাবে- এটা সম্ভব নয়। নির্বাচনের দিন ছাড়া গণভোটের বিকল্প নেই। সংসদের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে।’
গণভোট ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জামায়াত কেন আন্দোলনে, সেই প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, ‘আমরা ডেমোক্রেটিক প্রসেসে আগাচ্ছি। জনমত তৈরি করার জন্য আমরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করছি। আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি, ভয়েস রেইজ করছি, সরকারকে আমরা কনভিন্স করার চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও বলেন, আলোচনার প্রস্তাবে বেশির ভাগ দল ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিএনপি ডাকলে জামায়াত বসতে রাজি আছে বলে তিনি জানান।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘কথায় কথায় আপনি রাস্তায় যাবেন। এখন অন্য দল যদি তার প্রতিবাদে আবার রাস্তায় যায়, তাহলে কী হবে, সংঘর্ষ হবে না? বৃহত্তর দল বাংলাদেশে যদি রাস্তায় নামে এগুলোর প্রতিবাদে, সংঘর্ষ হবে। বাংলাদেশের মানুষ সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি চায় না, তারা চায় স্থিতিশীলতা। তাই যতটুকু ঐকমত্য হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হবে। যেগুলোতে ঐকমত্য হয়নি, তা জনগণের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’
এই অবস্থায় সরকার চলতি সপ্তাহে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারির পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের কথা ভাবছে। চলতি সপ্তাহেই প্রধান উপদেষ্টা দলগুলোকে বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। এ ছাড়া আইন মন্ত্রণালয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ প্রণয়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহে এ কাজ সম্পন্ন হতে পারে। তবে, এই আদেশ রাষ্ট্রপতি না প্রধান উপদেষ্টা কে জারি করবেন, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। এ ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন। অন্যদিকে ড. শাহদীন মালিকসহ আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকে এ ধরনের আদেশ জারির এখতিয়ার রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা কারো নেই বলে মনে করেন।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে একটি আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করা একান্ত প্রয়োজন। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে সরকারকে এই আদেশ জারির সুপারিশ করেছে কমিশন। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ কীভাবে জারি করা হবে, আইনি কাঠামোর মধ্য থেকে সে পথ বের করার উপায় খুঁজছে সরকার। কারও মতে, সংসদ কার্যকর না থাকায় অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা এখন রাষ্ট্রপতির হাতে। আবার কারও মতে, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো অধ্যাদেশ রাষ্ট্রপতি জারি করতে পারে না। কিন্তু এনসিপিসহ কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ মানবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে গণ-অভ্যুত্থানের পর বিশেষ পরিস্থিতিতে জনগণের অভিপ্রায়কে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা ও নানা বিতর্কের কথা বলা হচ্ছে। এ ধরনের বিতর্ক বিশ্বের অনেক জায়গায় ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে চলে। দ্বিমত থাকবে, তারপর ঐকমত্য হবে। মতভেদ থাকলেও শেষ পর্যন্ত দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হবে বলে সবাই আশাবাদী। তার পরও দলগুলো সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সরকার তার ওপরে অর্পিত দায়িত্ব অনুসারে একটা সিদ্ধান্ত দেবে। সরকার সে বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও তিনি জানান।