
দাম না বাড়ায় আলু নিয়ে বিপাকে কৃষক, ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিক। কইলে কইমেন মিছা কথা আলুর দাম নিয়ে কি দশা, ছাঁওয়া ছোট আসি কয় আলু বুঝি খাবার নয় কি কমো বাহে এলা তোমাক দুঃখের কথা। আলুর দাম নেই তবুও রং কমেনি রংপুরের ব্যবসায়ীদের। ভাওয়াইয়া গানের সুরে সুরে লোকসানের কথা বলছেন ব্যবসায়ী আরিফ। মৌসুমের শুরুতে হিমাগারে আলু রেখে এখন বড় লোকসানের মুখে আরিফসহ রংপুরের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুরের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে রংপুর মহানগরসহ কৃষি অঞ্চলের পাঁচ জেলায় ১ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৯ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে, উৎপাদন হয়েছে ৩২ লাখ ৩০ হাজার ৬৮২ টন। বিক্রির পরও বিভাগের ১১৬টি হিমাগারে এখনও মজুত আছে ৯ লাখ ৩৬ হাজার ২৮৩ টন আলু। যার দাম প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার মতো। হিমাগারে আলুর জাতভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকায়। অথচ উৎপাদন থেকে শুরু করে সংরক্ষণ পর্যন্ত খরচ পড়েছে কেজিতে প্রায় ২১ থেকে ২২ টাকা। ফলে কেজিপ্রতি প্রায় ১০-১২ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের। বস্তাপ্রতি (৬০ কেজি) লোকসান দাঁড়াচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
প্রান্তিকের চাষিরা খুচরা বাজারে কিছু আলু বিক্রি করলেও বাজারে চাহিদা না থাকায় দাম আরও কমে গেছে। অন্যদিকে, আলু না ওঠায় হিমাগারের ভেতরে কর্মচাঞ্চল্যও কমে গেছে। ফলে কৃষকদের উপর নির্ভরশীল হিমাগারকর্মচারীরাও পড়েছেন বিপাকে।
বাহারুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, আলু বিক্রিতে অনীহা ধরেছে, আলু কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া দিয়ে তুলে যে লস দেখছি, তাতে মনে হয় সেখানে হাত না দেওয়াই ভালো।
কৃষক স্বপন, ফেরদৌসসহ কয়েকজন সূত্রে জানা যায়, আলু কেজিতে চাষাবাদে খরচ ১৭ টাকা, কোল্ড স্টোরেজ খরচ ৬.৭২ বের করাসহ ৭ টাকা, বস্তায় খরচ ১.৫০ টাকা, যাতায়াত খরচ ১টাকা + ১ টাকা= ২ টাকা অর্থাৎ কেজিতে মোট খরচ প্রায় ২৭ টাকা। আলু বের করে ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এখন আপনারাই বলেন- আলু কি করব? বের করব, না কি পচাব।
অভিযোগের সুরে তারা আরও বলেন, সরকার যদি নেক নজর দিতো তাহলে আমরা বিপদ থেকে উদ্ধার হতাম। সরকার মাঝখানে আলুর রেট বেঁধে দিলেও পরে কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
রংপুর মহানগরের তামপাট এলাকার চাষি নুর ইসলাম ও ইছার আলী জানান, আলুর দাম এত কম যে সংসার চালানোই এখন কষ্টের। আমরা নিরুপায় হয়ে পড়েছি। পীরগাছা উপজেলার চাষি জাহাঙ্গীর আলম ও ফুল মিয়া বলেন, সামনে আবার আলুর মৌসুম আসছে। এবার চাষের টাকাও হাতে নেই। সরকার গত ২৭ আগস্ট হিমাগার থেকে আলুর দাম কেজি প্রতি ২২ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়েনি।
এ বিষয়ে রংপুর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এন.এম. আলমগীর বাদশা জানান, যারা আলু বিক্রি করতে চান, তারা ক্রেতা পাচ্ছেন না। বিক্রি কম হওয়ায় নির্ধারিত দাম বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।
রংপুর কৃষাণ হিমাগারের ম্যানেজার মাজেদুল ইসলাম বলেন, সরকারি তেমন কোনো পদক্ষেপ না থাকায় আলু খালাস না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে কৃষকের পাশাপাশি হিমাগারগুলোরও ক্ষতি হবে।
গোলডেন বীজ হিমাগার লিমিটেডের ম্যানেজার মো: বাইজিদুর রহমান চেীধুরী জানান, তারে হিমাগারে ৪৫ ভাগ আলু কৃষক নিয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৫ ভাগ বীজ আলু রয়েছে। তিনি আশা করেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বাকবী আলু কুষক নিয়ে যাবে।
শাহ আমানত হিমাগারের দায়িত্বশীল ওমর সানি জানান, দাম কিছু কম রয়েছে। এতে অনেক চাষি হিমাগারে মজুত আলু নিতে আসছেন না।
এদিকে দামের তুলনায় হিমাগারের ভাড়া বেশি হওয়ায় অনেকেই এখনও আলুর বের না করায় বিপাকে কোল্ড স্টোরেজ কর্তৃপক্ষও। রংপুর বিষাণ হিমাগারের ম্যানেজার মাইদুল ইসলাম বলেন, হিমাগারের খরচও উঠছে না এর ফলে বড় ক্ষতির মুখে এই ব্যবসা।
একই অবস্থা দেখা গেছে রংপুর হিমাগার দুইয়ে। যেখানেও বস্তা এবং খোলা আলু পড়ে আছে মেঝেতে। ভালো রাখতে পরিচর্যা করছেন হিমাগারের কর্মচারীরা। ধান, চালের মতো আলুর দামও সরকারিভাবে নির্ধারণসহ কৃষক, ব্যবসায়ী এবং হিমাগার মালিকদের বাঁচাতে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান সংশ্লিষ্টদের।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ও রংপুর কৃষি অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো: সিরাজুল ইসলাম জানান গত অর্থ বছরে রংপুর কৃষি অঞ্চলের ৫ জেলায় ১ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৯ হেক্টর জমিতে আরও চাষ করা হয়েছিল । এবছর ১ লাখ ১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে চাষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কৃষক আলুর দাম কম পাওয়ায় এবছর আলু জমিতে কম চাষ করা হবে।