
গত ৩ নভেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য একক প্রার্থী ঘোষণা করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে মাদারীপুর-১ আসনটির সম্ভাব্য মনোনয়ন স্থগিত করা হয়। ওইদিন প্রার্থী ঘোষণা শেষে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যারা যুগপৎ আন্দোলন করেছেন, যেসব আসনে তারা আগ্রহী, সেসব আসনে কোনো প্রার্থী দেইনি। শরিক দলগুলো তাদের নাম দিলে আমরা চূড়ান্ত করব।’ তিনি জানান, ২৩৭ আসন হচ্ছে বিএনপির সম্ভাব্য তালিকা, চূড়ান্ত নয়। এখানে পরিবর্তন আসতে পারে। বিশেষ করে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে কোনো কোনো আসনে পরিবর্তন আনা হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে সম্ভাব্য একক প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই অন্তত ২৩টি আসনে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদ হচ্ছে। এসব আসনে প্রার্থী পুনর্বিবেচনারও দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় নেতারা। এ নিয়ে কয়েকদিন ধরে গুলশান কার্যালয়েও বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বৈঠক করছেন। দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, একটি আসনে একাধিক প্রার্থী ছিলেন। তার মধ্যে একজনকে প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকিরা বঞ্চিত হয়েছেন। এই বঞ্চিতদের তালিকায় অনেক যোগ্যরাও আছেন। যারা মনোনয়ন পেয়েছেন, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে অন্যদের মান ভাঙিয়ে ঐক্য গড়া। সেটা করতে ব্যর্থ হলে ধানের শীষের বিজয়ের স্বার্থে প্রার্থী পরিবর্তনের মতো সিদ্ধান্ত নেবে দল। কিন্তু প্রার্থীরা ঐক্য তৈরির করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়ার পরও অন্যরা বিরোধিতা করলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারা বলেন, সব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে-স্থানীয় পর্যায়ের বিএনপির জনপ্রিয় কিছু নেতাও মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। তাদের অন্য রাজনৈতিক দল প্রার্থী করার প্রস্তাব দিচ্ছে। আবার স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের মাঠে প্রার্থী হিসাবে রাখতে চাইছে বড় একটি দল। এজন্য নানা প্রলোভনও দেওয়া হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপির ভোট ভাগাভাগির কারণে ওই দলের প্রার্থী জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। সব মিলিয়ে কিছু আসনে ঘোষিত মনোনয়ন পরিবর্তন হতে পারে। তবে এই পরিবর্তন স্থানীয় নেতাদের মতামত নিয়েই করা হবে।
বিএনপির ঘোষিত প্রার্থী তালিকাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি আসনে তৈরি হওয়া বিরোধ গত কয়েকদিনে আরও প্রকাশ্যে এসেছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অংশ হিসেবে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন মাঠপর্যায়ে তাদের অবস্থান নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান দিয়ে যাচাই করা হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করছেন না। তবে যাচাই-বাছাইয়ের পর ঘোষিত প্রাথমিক প্রার্থী তালিকাতে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির নেতারা। বিশেষ করে মনোনয়নবঞ্চিতসহ এলাকার ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রার্থীরা কেমন আচরণ করছেন-এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে দলটি। আবার ঐক্য তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রার্থী যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়ার পরও যদি কেউ বিরোধিতা করে তাহলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে ঘোষিত আসনের মধ্যে অন্তত ২৩টিতে চলছে বিরোধ। এসব আসনে মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা শক্ত অবস্থানে রয়েছেন বলে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল নেতাদের তদন্তে উঠে এসেছে। তাদের মতে, পুনর্মূল্যায়ন করা না হলে এর মধ্যে বেশ কয়েকজন নেতার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে সম্ভাব্য একক প্রার্থীদের মাঠের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করছে বিএনপি।
আরও ডজন খানেক প্রার্থী ঘোষণা হবে শিগগিরই : এদিকে ফাঁকা ৬৩ আসনের মধ্যে অন্তত ডজন খানেক আসনে দলীয় প্রার্থী শিগগিরই ঘোষণা দেওয়া বলে জানা গেছে। বিএনপি সূত্র জানায়, এ বিষয়ে কাজ করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। এসব আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে এরইমধ্যে কথাও বলেছেন তারা।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এবার প্রার্থী ঘোষণার ক্ষেত্রে একাধিক পেশাদার সংস্থার জনমত জরিপ এবং স্থানীয়ভাবে গ্রহণযোগ্যতা ও বিগত আন্দোলন-সংগ্রামের ভূমিকাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ আসনের প্রার্থী ঠিক করার ক্ষেত্রে স্থায়ী কমিটির খুব বেশি ভূমিকা ছিল না। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শিগগির দেশে ফিরতে পারেন। সেটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দু-চার দিন আগে-পরেও হতে পারে। সে লক্ষ্য থেকে কিছুটা আগেভাগে মনোনয়ন ঘোষণা করা হয়েছে; যাতে মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তফসিল ঘোষণার আগে প্রশমিত হয়ে যায় এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরার পর এ নিয়ে যাতে আর কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকে। অন্যদিকে তারেক রহমান দেশে ফেরার পর নেতাকর্মীদের মধ্যে যে উদ্দীপনা তৈরি হবে, সেটি নির্বাচনের কাজে লাগানোও বিএনপির লক্ষ্য রয়েছে। দলের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, ভোটে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের উপস্থিতি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও উজ্জীবিত করবে।
প্রার্থী না দেওয়া ৬৩ আসন : জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ৬৩টি আসনে এখনও প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি। এর মধ্যে কিছু আসনে প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে। আর কিছু আসন জোট ও সমমনা দলগুলোর প্রার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে, যাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে। কিন্তু জোটের জন্য রাখা আসনগুলোতে কারা মনোনয়ন পাচ্ছেন, তা নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে নানা আলোচনা চলছে। যদিও এখন পর্যন্ত বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতাদের কাছে পরিষ্কার নয়, যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী কিছু দল ও জোটের বাইরে শেষ পর্যন্ত আর কাদের পাশে পাচ্ছেন তারা।
ছয়টি দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, গণফোরাম ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ কিছু দল বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করবে। এর বাইরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), নুরুল হকের গণঅধিকার পরিষদ ও মাওলানা মামুনুল হকের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ব্যাপারে বিএনপির আগ্রহ আছে। দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ চলছে। সব মিলিয়ে বিএনপি কতটি আসন জোটের শরিকদের জন্য ছাড়বে বা শেষ পর্যন্ত কারা কারা বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, সেটি পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে প্রার্থী ঘোষণায় যাচ্ছে না বিএনপি।
তবে বিএনপির নেতাদের প্রাথমিক যে হিসাব বা বিবেচনা, তাতে এনসিপি ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ছাড়া বাকি দল ও জোটগুলো থেকে ২০-২৫টি আসনে মনোনয়ন পাওয়ার মতো প্রার্থী রয়েছেন।
এখন পর্যন্ত যে তথ্য, তাতে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটের জন্য বেশ কিছু আসন খালি রাখা হয়েছে। এর মধ্যে আ স ম রবের জন্য লক্ষ্মীপুর-৪ আসন, জোনায়েদ সাকির জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬, বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থর জন্য ঢাকা-১৭, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুরের জন্য পটুয়াখালী-৩, রাশেদ খানের জন্য ঝিনাইদহ-২, ফারুক হোসেনের জন্য ঠাকুরগাঁও-২ আসন, বাংলাদেশ জাতীয় দলের এহসানুল হুদার জন্য কিশোরগঞ্জ-৫, এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ঢাকা-১৩, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের জন্য পিরোজপুর-১, এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদের জন্য নড়াইল-২, এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদের জন্য কুমিল্লা-৭, অলি আহমদের ছেলে ওমর ফারুকের জন্য চট্টগ্রাম-১৪, বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিমের জন্য লক্ষ্মীপুর-১ আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে বলে বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
এ ছাড়া নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) নির্বাচন করতে চেয়েছেন। ওই আসনে বিএনপি এখন পর্যন্ত কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি।
দলটির হিসাব অনুযায়ী, এবার ৮৩ জন তরুণ প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছেন। বিএনপি বলছে, ‘ভবিষ্যৎ রাজনীতির নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যেই’ এই পদক্ষেপ। তবে এর পাশাপাশি বাদ পড়েছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, উপদেষ্টা আবদুস সালাম, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবীব উন নবী সোহেল, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় নেতা কামরুজ্জামান রতন।
রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘দল যা ভালো মনে করেছে, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার কোনো মন্তব্য নেই।’
এদিকে, মনোনয়ন ঘোষণার পর অন্তত সাতটি জেলায় বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় নেতাকর্মীরা মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে সড়কে নামেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, অনেক আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন এমন প্রার্থী, যারা দুঃসময়ে রাজপথে ছিলেন না বা দীর্ঘ সময় বিদেশে কাটিয়েছেন। বিপরীতে, দলের নিবেদিত নেতারা বঞ্চিত হয়েছেন মনোনয়ন থেকে। এতে ক্ষোভ দানা বাঁধলেও অনেকে সাংগঠনিক শাস্তির আশঙ্কায় প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না। বিএনপি হাইকমান্ড অবশ্য জানিয়েছে, ঘোষিত তালিকাটি চূড়ান্ত নয়। স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তে যেকোনো আসনে পরিবর্তন আনা হতে পারে।
জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ঘিরে সংঘর্ষ, অবরোধ, বিক্ষোভ এবং মিছিলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে বিএনপি। প্রতিটি আসন পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে কেন্দ্র থেকে। কাজ করছে সাংগঠনিক টিমও। দলের সিদ্ধান্ত যে বা যারা অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে হাইকমান্ড। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের অভিযোগে দল এবং এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতাকে এরইমধ্যে বহিষ্কারও করা হয়েছে।