
রাজধানীর হাইকোর্ট মোড় এলাকায় কাঁচামাল ব্যবসায়ী আশরাফুল হক হত্যার ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব। গ্রেপ্তারের তথ্য ও হত্যাকাণ্ড আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে আজ শনিবার পৃথক সংবাদ সম্মেলন করেছে পুলিশ ও র্যাব। সেখানে দুই আসামির জবানবন্দিতে দুই রকম তথ্য পাওয়ার কথা জানা গেছে। র্যাব বলছে, আশরাফুলকে ফাঁদে ফেলে ১০ লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরে তাকে হত্যা করা হয়। আর পুলিশ বলছে, ত্রিভুজ প্রেমের কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকা ও কুমিল্লায় অভিযান চালিয়ে দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের একজন হলেন জরেজুল ইসলাম (৩৯) ও আরেকজন শামীমা আক্তার (৩৩)। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেন র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন। সেখানে তিনি আসামি শামীমার বরাত দিয়ে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন।
গতকাল দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম। সেখানে তিনি ‘হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি’ জরেজুল ইসলামের বরাতে হত্যার বর্ণনা দেন।
১০ লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা থেকে হত্যা : সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, শামীমা জানিয়েছেন তার সঙ্গে জরেজুলের এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আশরাফুলকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ১০ লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছিলেন জরেজুল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১১ নভেম্বর জরেজুল ও আশরাফুল রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন। ১২ নভেম্বর তারা শনির আখড়া এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নেন। এ সময় শামীমাও তাদের সঙ্গে ছিলেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, আশরাফুলকে শরবতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ান শামীমা। পরে আশরাফুল ও শামীমার ভিডিও ধারণ করা হয়। এই ভিডিও দেখিয়েই টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করা হয়। ধারণকৃত ভিডিওটি শামীমার মোবাইল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। র্যাব আরও জানায়, ১২ নভেম্বর দুপুরে আশরাফুল পুরোপুরি অচেতন হয়ে পড়লে জরেজুল তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেন, মুখে স্কচটেপ লাগান। এরপর হাতুড়ি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করেন। অতিরিক্ত আঘাত এবং মুখে স্কচটেপ লাগানো থাকায় শ্বাস নিতে না পেরে আশরাফুল মারা যান। ১৩ নভেম্বর সকালে মরদেহ গুম করতে পাশের বাজার থেকে দুটি প্লাস্টিকের ড্রাম ও অন্যান্য সরঞ্জাম আনা হয়। পরে জরেজুল চাপাতি দিয়ে লাশ টুকরা টুকরা করে দুটি ড্রামে ভরে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় হাইকোর্ট এলাকায় রেখে যান। আশরাফুলের রক্তমাখা সাদা রঙের পাঞ্জাবি-পায়জামা, হত্যায় ব্যবহৃত দড়ি ও স্কচটেপ উদ্ধার করেছে র্যাব।
ত্রিভুজ প্রেম থেকে হত্যা : সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এই হত্যাকাণ্ড মূলত একটি ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি। হত্যার মূল আসামি জরেজুল ইসলাম মালয়েশিয়াপ্রবাসী। মালয়েশিয়া থাকা অবস্থায় একটি অ্যাপসের মাধ্যমে তিন বছরের বেশি সময় আগে শামীমা আক্তারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কও হয়। জরেজুল প্রায় দেড় মাস আগে দেশে আসেন। দেশে আসার পরও শামীমা ও জরেজুলের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মুঠোফোনে কথাবার্তা হতো। জরেজুলের স্ত্রী এটা জেনে যান। তখন জরেজুলের স্ত্রী জরেজুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আশরাফুল ইসলামের সহায়তা চান এবং আশরাফুল ইসলামকে শামীমার নম্বর দেন। পরে আশরাফুল শামীমার প্রেমে পড়ে যান। ভিডিও কলে তাদের মধ্যে যোগাযোগ হতো।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, এরই মধ্যে ১৪ লাখ টাকার বিনিময়ে জরেজুলকে জাপান পাঠানোর কথা বলেন শামীমা, যার মধ্যে ৭ লাখ টাকা তিনি দেবেন বলেও জানান। শামীমার কাছ থেকে টাকা ও জাপান যাওয়ার কাজ শুরুর জন্য ১১ নভেম্বর তিনি ও আশরাফুল রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আসার পর শনির আখড়ায় তারা তিনজন বাসা ভাড়া নেন।
পরে আশরাফুল ও শামীমার সম্পর্কের কথা জানতে পারেন জরেজুল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তর্ক হয়। একপর্যায়ে শামীমা চিৎকার করলে আশরাফুলের হাত বেঁধে জরেজুল হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেন। পরে আশরাফুলের মুখের ভেতরে ওড়না ঢুকিয়ে স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে দেন। এর কিছুক্ষণ পর আশরাফুল মারা যান। পরে তারা মরদেহ টুকরা করে প্লাস্টিকের ড্রামে ভরে হাইকোর্ট এলাকায় ফেলে দিয়ে আসেন।
আশরাফুলের দাফন সম্পন্ন, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া : ঢাকায় নৃশংসভাবে খুন হওয়া রংপুরের বদরগঞ্জের আশরাফুল হকের জানাজা ও দাফন ঘিরে এলাকায় গভীর শোক নেমে এসেছে। গতকাল শনিবার ভোর থেকে হাজারো মানুষ ভিড় করেন বদরগঞ্জের গোপালপুর ইউনিয়নের নয়পাড়া গ্রামে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে আশরাফুলের জানাজা সম্পন্ন হয়। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনেরা। এর আগে গত শুক্রবার গভীর রাতে আশরাফুলের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। সকালে জানাজায় অংশ নিতে দূরদূরান্ত থেকে মুসল্লিরা ছুটে আসেন। জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন করা হয়। মায়ের আহাজারি, স্বজনদের কান্না আর বিহ্বল মানুষের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে আশরাফুলের শেষবিদায়ের মুহূর্ত।
স্থানীয় লোকজন জানান, হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই আশরাফুলের পরিবার শোকে মুহ্যমান। পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন- বাল্যবন্ধু জরেজ আশরাফুলকে ডেকে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন। এ ঘটনায় নিহত আশরাফুলের বোন আনজিনা বেগম শুক্রবার সকালে ঢাকার শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় আশরাফুলের বন্ধু জরেজুল ইসলাম জরেজকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে জরেজুল ইসলাম ও শামীমা নামের এক নারীকে। আহাজারি করতে করতে আশরাফুল হকের স্ত্রী লাকী বেগম বলেন, ‘নিজের ভাই মনে করত জরেজকে। জাপান যাওয়ার ১০ লাখ টাকা চাইছিল, সেই টাকাও আমরা দিতে চাইছি। আরও টাকা লাগলে নিত। আমার সব সম্পত্তি নিয়া স্বামীটারে বাঁচাই রাখত। স্বামীটার জান কেন কাড়ি নিল। আমি উনার (জরেজের) ফাঁসি চাই। যারা আমার স্বামীরে টুকরা টুকরা করছে, সবার ফাঁসি চাই।’
বাবা আবদুর রশিদের বিলাপ, ‘হাসপাতালে ছিলাম। জরেজ খুব তাগদা দিয়া ছেলেটারে ঢাকা নিয়া গেছে। বাবাটাক খুন করবে জানলে নিজের জান দিয়াও ঢাকা যাবার দিতাম না। ছোট নাতি-নাতনি, আমাদের এখন কে দেখবে।’ মা এছরা খাতুন মূর্ছা যাচ্ছেন। স্বজনেরা জ্ঞান ফেরালে বিলাপ করছেন, ‘আমার বেটা তো কারও ক্ষতি করে নাই। তাহলে কেন এমন করল ওরা? কেন আমার বেটাকে টুকরা টুকরা করল?’
পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মা- বাবার একমাত্র ছেলে আশরাফুল হক। তার চার বোন আছে। ভাই- বোনের মধ্যে আশরাফুল তৃতীয়। তার বাবা আবদুর রশিদ ছিলেন একজন ক্ষুদ্র কাঁচামাল ব্যবসায়ী। ছোট থাকতেই বাবার হাত ধরে কাঁচামাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন আশরাফুল। তিনি কাঁচামাল আমদানিকারক ছিলেন। বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁচামাল এনে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন আড়তে দিতেন। তাঁর সংসারে ১৩ বছর বয়সী সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক মেয়ে ও ৭ বছর বয়সী এক ছেলে আছে।
এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য আমজাদ হোসেন বলেন, আশরাফুল কাঁচামালের ব্যবসা করতেন। তিনি একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। কাঁচামাল ট্রাকে করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাতেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত নম্র ও ভদ্র মানুষ ছিলেন। বছরের দুই ঈদে এলাকার গরিব মানুষদের দুই হাত প্রসার করে শাড়ি লুঙ্গিসহ শুকনা খাবার বিতরণ করতেন। গরিব মানুষদের জন্য প্রতিবছর কোরবানির ঈদে একটি গরু কিনে মাংস বিতরণ করতেন। তাকে হত্যাকারী যেই হোক, তার বিচার চান তিনি।
বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, সকালে আশরাফুল হকের লাশ তার নিজ গ্রামে দাফন হয়েছে। তাকে হত্যার ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। তার সঙ্গে থাকা বন্ধু জরেজুল ও শামীমা নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১১ নভেম্বর মালয়েশিয়া ফেরত বন্ধু জরেজুল ইসলামের সঙ্গে ঢাকায় যান আশরাফুল। এরপর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানী ঢাকার হাইকোর্টসংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের গেটের পাশে একটি ড্রাম থেকে এক তার খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।