
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গতকাল শুক্রবার শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এতে তিন জেলায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যু এবং ছয় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে এ ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদী জেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ২৩ দশমিক ৮৯ উত্তর অক্ষাংশ ও ৯০ দশমিক ৫৭ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের উপরে এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে।
তিন জেলায় নিহত ১০ : রাজধানীর পুরান ঢাকার বংশালে রেলিং ধসে তিনজন পথচারী এবং মুগদায় এক নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়েছেন। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে একজন ও নরসিংদীতে পাঁচজন নিহত হন। এসব ঘটনায় ছয় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন এবং বহু মানুষ আতঙ্কিত অবস্থায় রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ উপজেলায় ভূকম্পের ঘটনায় দেয়াল ধসে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন তার মেয়ে। একই উপজেলায় ভূমিকম্পে একটি টিনসেড বাড়ির দেয়াল ধসে ফাতেমা (১) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় শিশুর মা কুলসুম বেগম ও প্রতিবেশী জেসমিন বেগম আহত হয়েছেন।
এছাড়া ওই জেলায় অনেকে আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। নরসিংদীতে সদর উপজেলার গাবতলী এলাকায় বাড়ির সানসেট ভেঙে ওমর (১০) নামে এক শিশু নিহত হয়েছে। এই ঘটনায় তার বাবা দেলোয়ার হোসেন উজ্জল গুরুতর আহত হয়েছেন। একই উপজেলায় ভূমিকম্পে মাটির দেওয়াল ধসে চাপা পড়ে কাজম আলী (৭৫) নামে এ বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। জেলার পলাশের মালিতা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এছাড়াও ভূমিকম্পে জেলাজুড়ে অন্তত ৫৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছাদের রেলিং ভেঙে একসঙ্গে তিনজন আহত হন।
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে মাঠপর্যায়ে কাজের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার : দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর সৃষ্ট জনমনের উদ্বেগ ও আতঙ্ক সম্পর্কে সরকার সম্পূর্ণভাবে অবগত রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা গতকাল এক বার্তায় বলেন, ‘পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরকে অবিলম্বে মাঠপর্যায়ে নেমে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘কোনো ধরনের গুজব বা বিভ্রান্তিতে কান না দিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। প্রয়োজনে হটলাইনসহ সরকারি চ্যানেলে পরবর্তী দিকনির্দেশনা জানানো হবে।’ তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
হেলে পড়ল রাজধানীর বেশ কয়েকটি ভবন, ধরেছে ফাটল : দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মোকাররম ভবনের দেয়ালে ফাটল ধরেছে। শেখ মুজিব হলের পুরাতন ভবনের ৩য় তলার ছাদের ফাটল ধরেছে। টঙ্গী রেলস্টেশন রোডের একটি ভবন হেলে পড়ে। রাজধানীর স্বামীবাগ এলাকার ৫২/এ নম্বর ভবনটি পেছনের একটি ভবনের দিকে হেলে পড়েছে। রাজধানীর বংশালে কশাইতলীতে ৫তলা ভবনে ফাটল। রাজধানী কালাচাঁদপুরের ৭তলা ভবনে ফাটল।
ঘোড়াশালের সাবস্টেশনসহ ৭ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ : দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে নরসিংদীর ঘোড়াশালের বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে করে সাবস্টেশনটিসহ দেশের ৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। শুক্রবার এক বার্তায় এ তথ্য জানায় পিডিবি। বার্তায় জানানো হয়, বন্ধ হয়ে যাওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিবিয়ানা ২ (সামিট) ৩৪১ মেগাওয়াট, বিবিয়ানা ৩ (বিপিডিবি) ৪০০ মেগাওয়াট এসটি (১৩৪ মেগাওয়াট), আশুগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট (এপিএসসিএল) এসটি (৭৫ মেগাওয়াট), আশুগঞ্জ প্রিসিরিয়ন ৫৫ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জ টিএসকে ৫০ মেগাওয়াট, এসএস পাওয়ার ইউ-২ ৬০০ মেগাওয়াট, সিরাজগঞ্জ ইউ-১ ২২৫ মেগাওয়াট সিসিপিপি এসটি (৭৫ মেগাওয়াট)। এছাড়া নরসিংদীর ঘোড়াশালের এআইএস গ্রিড সাব-স্টেশনে আগুন লাগায় ঘোড়াশাল এসএসসহ সব ২৩০ কেভি, ১৩২ কেভি এবং ৩৩ কেভি লাইন এখন বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছে।
গাজীপুরে পোশাক কারখানায় তিন শতাধিক শ্রমিক আহত : গাজীপুরের শ্রীপুরে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর একটি পোশাক কারখানায় তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে তিন শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছেন। ভূমিকম্পের সময় শ্রীপুর পৌরসভার গড়গড়িয়া মাস্টার বাড়ি এলাকায় ডেনিমেক লিমিটেড পোশাক কারখানায় এ ঘটনা ঘটে। কারখানার শ্রমিকরা জানান, ভূমিকম্পের সময় ৭ তলা ভবনের ওই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এসময় কারখানা কর্তৃপক্ষ ফায়ার অ্যালার্ম বেজে উঠলে কর্মরত শ্রমিকরা ফ্লোর থেকে নামার সময় পদদলিত হয়ে ও ভয়ে অনেক শ্রমিক আহত হন। শ্রমিকের স্বজনরা আহতদের গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা পঙ্গু হাসপাতাল (নিটোর), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডেনিমেক কারখানার অনেক শ্রমিক জানান, হাসপাতালে তারা শয্যা স্বল্পতার কারণে তাদের আহত শ্রমিক ও স্বজনদের অন্যান্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক স্বেচ্ছাসেবীরা আহত শ্রমিকদের যানবাহনসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতে দেখা গেছে।
শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সাইয়িদা আফরোজ ইমা জানান, এ পর্যন্ত ৭০-৮০ জন শ্রমিক হাসপাতালে রেজিস্ট্রার হয়েছে। তবে হাসপাতালে বেড স্বল্পতার কারণে আহতদের স্বজনরা তাদের এ হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া টঙ্গীতে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে শতাধিক অসুস্থ ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফায়ার সার্ভিস স্টেশন অফিসার মো. শাহিন জানান, একটি পোশাক কারখানায় তাড়াহুড়া করে এখান থেকে বেশ কিছু শ্রমিক আহত হয়েছেন। একটি ভবন হেলে পড়েছে বলে শুনেছি। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের পাঠানো হয়েছে।
ভূমিকম্পের সময় কুমিল্লা ইপিজেডের অর্ধশতাধিক নারী শ্রমিক অজ্ঞান : ভূমিকম্পের সময় কুমিল্লা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) তাড়াহুড়ো করে বের হওয়ার সময় অর্ধশতাধিক নারী শ্রমিক অচেতন হয়ে পড়েছেন। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার সকালে ভূমিকম্পের সময় তাড়াহুড়ো করে নামার সময় তারা অচেতন হয়ে পড়েন। এ সময় ৫ নারী আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কুমিল্লা ইপিজেডের ভবনগুলোতে ভূমিকম্প অনুভূত হতেই নারী কর্মীরা আতঙ্কে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। অনেকেই দৌড়ে বের হতে গিয়ে পড়ে গিয়ে আঘাত পান। কেউ কেউ ভয়ে অজ্ঞান হয়ে অফিসের মেঝেতে পড়ে যান। পরে তাদের উদ্ধার করে ইপিজেডের বেপজা হাসপাতাল এবং কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
কুমিল্লা ইপিজেড পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ভূমিকম্প শুরু হতেই দুটি কোম্পানির নারী শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হুড়োহুড়ির মধ্যে অনেকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। তবে গুরুতর কেউ আহত হননি। সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাসায় পাঠানো হয়েছে।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তানভীর আহমেদ বলেন, হাসপাতালে অন্তত ৩০ নারী কর্মীকে আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি। তাদের বেশির ভাগই আতঙ্ক ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। এদিকে ভূমিকম্পে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার একটি পাঁচতলা ভবন হেলে পড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। একই উপজেলার আরও একটি ভবনে ফাটল দেখা গেছে। ভূমিকম্পের পর পুরো কুমিল্লা নগরীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, তবে বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
ভূমিকম্পে আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসার নির্দেশ স্বাস্থ্য উপদেষ্টার : ভূমিকম্পে আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সব হাসপাতালে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গিয়ে আহতদের চিকিৎসার খোঁজ নেন তিনি। ঢামেক হাসপাতাল পরিদর্শক শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে শিশু ও নারীসহ অনেকেই আহত হয়েছেন এবং সবার সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করছে সরকার। তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলে ৩৯ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। আর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ভূমিকম্পে আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সব হাসপাতালে নির্দেশনা দেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টার।