
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট হবে একই দিনে। এই বিধান রেখে গণভোট অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। পৃথক ব্যালট পেপারে চারটি বিষয়ের ওপর একটি প্রশ্নে হবে এই গণভোটে। গণভোটের ব্যালট পেপার হবে রঙিন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো গণভোটেও প্রবাসীসহ চার শ্রেণির নাগরিকদের জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনু্ষ্িঠত হয় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে ঐক্য হয়, কিন্তু সময়ে গণভোট হবে তা নিয়ে মতভেদ দেখা যায়। পরে গণভোটের সময়ের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেয় ঐকমত্য কমিশন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক করে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দেয় সরকার। জানা গেছে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার বিষয়ে জনগণের মতামত জানতে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে, তার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া এই অধ্যাদেশে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। রঙিন ব্যালট ব্যবহারের ফলে ভোটারদের পছন্দ নির্ধারণ আরও সহজ হবে। বিশেষ করে বয়স্ক বা স্বল্পশিক্ষিত ভোটারদের জন্য রঙিন চিহ্ন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। এছাড়া গণনা প্রক্রিয়া হবে দ্রুত, কারণ ভোট গণনার সময় পৃথক রঙ সহজেই শনাক্ত করা যাবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশ বলছে, নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়নে সতর্কতা প্রয়োজন। রঙিন ব্যালট ব্যবহারের আগে আইনগত কাঠামো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ফলাফল প্রকাশ করা উচিত। এতে ভোটার আস্থা আরও বাড়বে। গণভোটকে সহজ, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে ব্যালটের নিরাপত্তায় বিশেষ জলছাপ ও মাইক্রো টেক্সটসহ আধুনিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেবে নির্বাচন কমিশন। কমিশন আশা করছে, রঙিন ব্যালট ব্যবহারের মাধ্যমে ভোট প্রক্রিয়া আরও গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বমানের হবে।
গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একইদিনে অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। গণভোট কিভাবে গ্রহণ করা হবে, সে প্রক্রিয়ার বিস্তারিত উল্লেখ করে গণভোট অধ্যাদেশ চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়েছে। আজ (মঙ্গলবার) বা কাল (বুধবার) গেজেট নোটিফিকেশন হবে। গণভোটে একটি মাত্র প্রশ্ন থাকবে। প্রশ্নটা হলো- জুলাই জাতীয় সনদ আদেশ ও সংবিধান সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবে ভোটারের সম্মতি আছে কি না। সেখানে হ্যাঁ ও না দুটি বক্স থাকবে। সম্মতি জানালে ‘হ্যাঁ’ ভোট, অসম্মত হলে ‘না’ ভোট দিতে হবে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালট থেকে গণভোটের ব্যালট আলাদা হবে। গণভোটের ব্যালট রঙিন হবে যেন ভোটার বিভ্রান্ত না হয়। সাধারণত সংসদ নির্বাচনের ব্যালট হয় সাদাকালো। আসিফ নজরুল বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনের জন্য কমিশনের নিয়োগকৃত রিটার্নিং, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার বা পোলিং অফিসাররাই গণভোটে রিটার্নিং অফিসার, পোলিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।’ গণভোটের ক্ষেত্রেও পোস্টাল ব্যালটের সুযোগ থাকবে বলে জানান আইন উপদেষ্টা।
গণভোটের ব্যালট পেপার হবে রঙিন : গতকাল রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একদিনে অনুষ্ঠিত হলেও গণভোটের ব্যালট পেপার ‘রঙিন হবে’। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট উভয় ক্ষেত্রেই পোস্টাল ব্যালট থাকবে। জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট হবে সাদা কাগজের ওপর কালো প্রতীক। আর গণভোটের ব্যালট হবে রঙিন কাগজের ওপর দৃশ্যমান যে কোনো কালি। তিনি বলেন, আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত হবে। সে অনুযায়ী নির্বাচনি প্রস্তুতি এগোনো হবে। সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে। প্রবাসীরাও গণভোট দিতে পারবেন। ব্যালট পেপার প্রিন্টিং বিষয়ে সরকারি প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে বলেও জানান ইসি সচিব।
প্রসঙ্গত, জুলাই সনদের আলোকে গণভোটের ব্যালটে উপস্থাপন করা প্রশ্নও নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রশ্নটি হবে: আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন? ক) নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে। খ) আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে। গ) সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে। ঘ) জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে। গণভোটের দিন এই চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে মতামত জানাতে পারবেন ভোটাররা।