
পাকিস্তানের কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নিয়ে গুজব, গুঞ্জনে গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশ শোরগোল চলছে। এই গুজব আরও তীব্রতা পেয়েছে ইমরানের বোনদের অভিযোগে। তারা জানিয়েছেন, ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারের বাইরে রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক ‘নৃশংস’ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা। ইমরানের তিন বোন, নোরিন নিয়াজি, আলিমা খান এবং ড. উজমা খান জানিয়েছেন, তাদের ভাই পাকিস্তানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের চেয়ারম্যান ইমরানের সঙ্গে তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে তাদের দেখা করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। তাকে আদিয়ালা কারাগারের ভেতরে হত্যা করা হয়েছে বলে সূত্রের বরাত দিয়ে আফগানিস্তানের একটি গণমাধ্যম খবর প্রকাশ পর এ নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে ওঠে। এবার ইমরানের ছেলে কাসিম খান তার বাবার জীবিত থাকার প্রমাণ চেয়েছেন এবং পাকিস্তান তেহরিকই ইনসাফের (পিটিআই) এ শীর্ষ নেতাকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি তুলেছেন। এক্সে দেওয়া পোস্টে কাসিম বলেছেন, তার বাবার ৮৪৫ দিন ধরে কারাগারে এবং গত দেড় মাস ধরে তাকে ফাঁসির আসামিদের জন্য বরাদ্দ নির্জন কক্ষে রাখা হয়েছে, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ‘গত ছয় সপ্তাহ ধরে তাকে একটি মৃত্যু কুঠুরিতে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখা হয়েছে। আদালতের আদেশ সত্ত্বেও তার বোনদের প্রতিবার দেখা করার সময় বাধা দেওয়া হয়েছে। কোনো ফোন কল নেই, কোনো দেখা সাক্ষাৎ নেই, তার শারীরিক অবস্থার কোনো খবর নেই। আমার ভাই ও আমি কোনোভাবেই আমাদের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না,’ ২৬ বছর বয়সী পোস্টে এসব লিখেছেন বলে জানিয়েছে এনডিটিভি।
এ ইমরানপুত্রের অভিযোগ, বাবার ব্যাপারে তাদের ‘পুরোপুরি আঁধারে’ রাখা হয়েছে যা কোনো ‘নিরাপত্তা সংক্রান্ত আচরণবিধির’ অংশ হতে পারে না। ‘পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, আমার বাবার নিরাপত্তা এবং এই অমানবিক নির্জন কারাবাসের প্রতিটি প্রতিক্রিয়ার সম্পূর্ণ আইনি, নৈতিক ও আন্তর্জাতিক দায় পাকিস্তানি সরকার ও তাদের প্রভুদের বহন করতে হবে,’ বলেন কাসিম। তিনি তার বাবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে হস্তক্ষেপ করতেও অনুরোধ জানিয়েছেন।
কাসিম তার বাবা যে জীবিত আছে তার প্রমাণ, আদালতের আদেশ অনুযায়ী তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ, ‘অমানবিক নির্জন কারাবাসের’ অবসান এবং কেবলই রাজনৈতিক কারণে আটক ‘পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতার’ মুক্তিও দাবি করেছেন। ইমরানের তিন বোনের একজন, আলিমা খানও বলেছেন, তার ভাইকে দেখতে পরিবারের সদস্যদের অনুরোধ বারবার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ‘গত ৬-৭ মাস ধরে তারা নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে। কখনো তারা আমাকে দেখা করতে দিয়েছে, কখনও অন্য বোনদের কাউকে দেখা করতে দিয়েছে, কখনও কখনও কাউকেই দেখা করতে দেয়নি। অনেকবার আমরা বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি,’ টেলিফোনে এনডিটিভিকে এমনটাই বলেছেন আলিমা। এদিকে গত বৃহস্পতিবার আদিয়ালা জেল কর্তৃপক্ষ ইমরান খানের স্বাস্থ্য নিয়ে গুজব উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, পিটিআই নেতা ‘পুরোপুরি সুস্থ আছেন’। ‘ইমরান খানের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য পিটিআই নেতাদের জানানো হয়েছে। পিটিআই প্রধানের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে,’ বিবৃতিতে বলেছে তারা। ইমরান খানকে অন্য কারাগারে স্থানান্তরের খবরকেও ‘ভিত্তিহীন গুজব’ আখ্যা দিয়েছে আদিয়ালা কারাগার। সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী ২০২৩ সালের অগাস্ট থেকেই নিরাপত্তা হেফাজতে রয়েছেন, তার বিরুদ্ধে অনেক মামলাও হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দুর্নীতির এক মামলায় তাকে ও তার স্ত্রীকে যথাক্রমে ১৪ ও ৭ বছরের কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলছেন ইমরান।
‘ইমরান খানের জীবিত থাকার কোনো প্রমাণ নেই’ : পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ছেলে কাসিম খান তার বাবার জেলজীবন নিয়ে কড়া অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেন, তার বাবা টানা ৮৪৫ দিন ধরে কারাগারে আছেন। গত ছয় সপ্তাহ ধরে তাকে একা একটি ‘ডেথ সেলে’ রাখা হয়েছে। কোনো পরিবার সদস্য তাকে দেখতে পারছেন না। এমনকি আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও জেল কর্তৃপক্ষ কাউকে সাক্ষাৎ করতে দিচ্ছে না। কাসিম খানের দাবি, তার বাবার বোনদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, তিনি ও তার ভাইদের সঙ্গে ‘কোনো যোগাযোগ’ নেই এবং ‘জীবিত থাকারও কোনো প্রমাণ’ নেই। তিনি লেখেন, ‘এই পুরো অন্ধকার পরিস্থিতি কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নয়। এটি ইচ্ছাকৃতভাবে তার অবস্থা গোপন করার চেষ্টা।’ তিনি সতর্ক করেন, সরকার এবং ‘তার হ্যান্ডলারদের’ জবাবদিহি করতে হবে। তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানের ‘সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাকে’ যে ‘অমানবিক বিচ্ছিন্নতায়’ রাখা হয়েছে, তা বন্ধ করতে হবে এবং অবিলম্বে তার জীবিত থাকার প্রমাণ দিতে হবে। ইমরান খানের বোন নুরিন নিয়াজি দাবি করেন, পাকিস্তানে ভয়ংকর সেন্সরশিপ চলছে। তিনি এএনআই-কে বলেন, সাংবাদিক ও মিডিয়া মালিকদের আটক করা হচ্ছে, ভয় দেখানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানে সেন্সরশিপ এতটাই কঠোর যে মিডিয়ার মানুষদের ধরে নিয়ে যায় তাদের এত চাপ দেওয়া হয় যে ছাড়া পাওয়ার পর তারা কিছু বলতে পারেন না।’ তিনি আরও বলেন, পরিচিত কিছু সাংবাদিক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, তাদের পাসপোর্ট ও সম্পদও আটকে দেওয়া হয়েছে। তার ভাষায়, ‘হিটলারের সময়ের কথা পড়েছি পাকিস্তানে এখন একই ঘটনা ঘটছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, শাহবাজ শরিফের সরকার ‘একেবারেই জনপ্রিয় নয়।’ তিনি বলেন, নির্বাচন হয়েছে ‘কারচুপির মাধ্যমে,’ আর সরকার দুর্বল ও দমনমূলক। তিনি মনে করেন, পশ্চিমা দেশগুলো পাকিস্তানের ‘প্রতারণা’ জানে, কিন্তু তারা পদক্ষেপ নেবে না। তীব্র প্রতিবাদ করছে পিটিআই নেতৃত্বও। খাইবার পাখতুনখোয়ার মুখ্যমন্ত্রী সোহাইল আফ্রিদি টানা অষ্টমবার ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করতে ব্যর্থ হন। গত ২৭ নভেম্বর তিনি আদিয়ালা জেলের কাছে ধর্ণা দিয়েছিলেন। পুলিশ তাকে ও পিটিআই কর্মীদের জেল ফটকে পৌঁছাতে দেয়নি। আফ্রিদি বলেন, আদালতের আদেশ মানা হচ্ছে না। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘২.৫ কোটি মানুষের’ প্রতিনিধিকে কেন আটকানো হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, খানের বোন, আইনজীবী ও চিকিৎসকদেরও ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে পিটিআই নেতারা, যেমন জুলফি বুখারি ও মেহর বানো কুরেশি, সরকারের কাছে খানের স্বাস্থ্যের বিষয়ে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ বিবৃতি চান। তারা অবিলম্বে পরিবারকে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানান। তবে আদিয়ালা জেল কর্তৃপক্ষ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো খবর ‘ভিত্তিহীন’। কর্তৃপক্ষ জানায়, ইমরান খান ‘পুরোপুরি সুস্থ’ আছেন এবং তাকে কোথাও সরানো হয়নি। তাদের দাবি, কোনো জরুরি চিকিৎসা বা বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হয়নি। সাম্প্রতিক গুজব অনলাইনে আরও ছড়ায় যখন কয়েকটি বিদেশি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট দাবি করে যে ইমরান খান নাকি কারাগারে মারা গেছেন। তবে এসব দাবি কোনো নির্ভরযোগ্য সংস্থা নিশ্চিত করেনি। গুজব আরও জোর পায়, যখন খানের তিন বোন-নুরিন নিয়াজি, আলীমা খান ও ড. উজমা খান অভিযোগ করেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে জেলের বাইরে অবস্থান করছিলেন, কিন্তু পুলিশ ‘নৃশংস ও পরিকল্পিত’ হামলা চালায়। তারা বলেন, স্ট্রিটলাইট নিভিয়ে তাদের টেনে-হিঁচড়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। নুরিন নিয়াজি বলেন, তাকে চুল ধরে টেনে ফেলা হয় এবং তিনি আহত হন। তারা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে খানের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। আদিয়ালা জেল পাঞ্জাব সরকারের অধীনে, যার নেতৃত্বে আছেন মুখ্যমন্ত্রী মরিয়ম নওয়াজ। তিনি বলেন, খানের সাক্ষাৎ-সংক্রান্ত বিষয়ে তার ‘কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ অন্যদিকে ইমরান খান আগেই দাবি করেছিলেন, জেলের সব বিষয় একজন সেনা কর্নেল নিয়ন্ত্রণ করছেন।
কঠিন নির্যাতন করা হচ্ছে ইমরানকে, দুশ্চিন্তা বাড়ছে পাকিস্তানে : পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ইমরান খানকে আদিয়ালা কারাগারে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখা হয়েছে। তারা দাবি করেছে, তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়েছে এবং উচ্চমাত্রার বন্দিত্বে রাখা হয়েছে। পরিবারের সদস্য বা আইনজীবীদের সাথে তার কোনো অর্থবহ যোগাযোগ নেই বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। পরিবারকে সাক্ষাতের অনুমতি না দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। ইমরানের বোন আলিমা খানম বলেন, ‘তারা আমাদের সাক্ষাৎ করতে দিচ্ছে না কেন? কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে? তাকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে দিলে বিষয়টা এত বড় হতো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না যে তারা ইমরানকে কারাগারের ভেতর ক্ষতি করবে। করলে মানুষ তাদের ছেড়ে দেবে না, আর পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা পাবে না।’ ইমরান খানের স্বাস্থ্য নিয়ে গুঞ্জন ছড়ালেও সরকার বলছে, তার শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক। তবে পিটিআইয়ের ভেতরের অনেকেই বলছেন, তার শারীরিক অবস্থা ভালো নয় এবং ধীরে ধীরে অবনতি হচ্ছে। তারা দাবি করছে, দীর্ঘ চাপ, কঠোর আচরণ এবং যোগাযোগহীনতার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আগে খাইবার পাখতুনখোয়ার মুখ্যমন্ত্রী নিয়মিত তার সাথে দেখা করতেন। কিন্তু সূত্র বলছে, ওই সাক্ষাৎগুলো ব্যবহার করা হয়েছে ইমরানের স্বাস্থ্য নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য। তারা অভিযোগ করে বলেছে, ‘তিনি আসল পরিস্থিতি গোপন করছিলেন।’ ইমরানের বোনরা তার প্রকৃত অবস্থার বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বললে দেশে বড় ধরনের বিক্ষোভ হতে পারে- এমন আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে তারা উচ্চ আদালতে আবেদন করেছেন তাকে জরুরিভিত্তিতে দেখার অনুমতি চেয়ে।