ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সন্দেহভাজন শনাক্ত, ধরিয়ে দিলে ৫০ লাখ টাকা

সন্দেহভাজন শনাক্ত, ধরিয়ে দিলে ৫০ লাখ টাকা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তার নাম ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ ওরফে রাহুল। হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল শনিবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সম্মুখসারির যোদ্ধা ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছে। বিষয়টিকে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘এ হামলায় জড়িত কাউকে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে আমরা জনগণের কাছ থেকে সার্বিক সহযোগিতা পাব বলে দৃঢ় বিশ্বাস করি। ওসমান হাদির ওপর আক্রমণের ঘটনা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস বলে আমরা মনে করি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত বা বানচাল করার যেকোনো অপচেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর হস্তে দমন করবে।’

হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সন্দেহভাজন ব্যক্তির নাম ফয়সাল : জানা গেছে, ফয়সালের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কেশবপুর ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে; উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে। ফয়সাল ওই এলাকর মো. হুমায়ুন কবির ওরফে আবদুল মালেক মুন্সির ছেলে। ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় আলোচনায় আসা ফয়সালকে ওই এলাকায় নতুন করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, তার ফয়সালে পৈত্রিক বাড়ি বাউফলে হলেও অনেক বছর ধরে তাকে এলাকায় দেখেনি কেউ।

এমনকি তার বাবা কিংবা পরিবার কাউকে এলাকা দেখা যেত না। গতকাল শনিবার সরেজমিনে স্থানীয় বাসিন্দা ও বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফয়সাল করিম মাসুদের জন্ম ঢাকায়। স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বজনদের ভাষ্যমতে, ফয়সাল করিম কোনোদিন গ্রামের বাড়িতে আসেননি।

তারা জানান, ফয়সাল করিম মাসুদের বাবা মো. হুমায়ুন কবির এলাকায় ‘আবদুল মালেক মুন্সি’ নামে পরিচিত ছিলেন। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে সেজো হলেন হুমায়ুন কবির। তিনি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। প্রায় ৩৫ বছর আগে ঢাকায় চলে যান। হুমায়ুন কবিরের বাবা মো. দেলোয়ার হোসেন মুন্সি ও মা রাজু বিবি মারা যাওয়ার পরেও এলাকায় আসেননি ফয়সালের পরিবার। বাবা ও মা মৃত্যুর পর প্রায় ১০ বছর আগে একবারই বাউফলে এসেছিলেন হুমায়ুন কবির। তখন পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সাড়ে ছয় শতাংশ জমি তিনি তার চার ভাইয়ের কাছে বিক্রি করে চলে যান। তখনও বাড়িতে যাননি। হুমায়ুন কবিরের ছোট ভাই মো. সেলিম মুন্সির স্ত্রী মোছা. মিনারা বেগম (৬০) বলেন, হুমায়ুনের তিন ছেলে আছে। কিন্তু তাদেরকে তিনি কোনোদিনও দেখেননি। তাদের (মিনারা) সঙ্গে ওই পরিবারের (হুমায়ুন কবির) কারও যোগাযোগ নেই। এমনকি বাবা, মা ও বড় ভাই মারা যাওয়ার পরেও বাড়িতে আসেননি হুমায়ুন কবির ও স্ত্রী, সন্তানেরা।

তিনি যেটুকু জমি পেয়েছিলেন তা বিক্রি করে দিয়েছেন। কেশবুপর ইউনিয়ন পরিষদের দুই নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘হুমায়ুন কবীর বললে কেউ চিনবে না। তার নাম আব্দুল মালেক। মালেকের ছেলে নাকি ঢাকার কোন নেতাকে গুলি করছে। এমন খবর গত শুক্রবার রাতে বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি। তবে মালেক ও তার ছেলেদের কাউকে আমি কখনও দেখি নাই। এলাকায় আসেনি। এলাকায় তাদের সম্পদও নাই। বাউফল থানার পরিদর্শক মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সন্দেহভাজন শনাক্ত একজন হলেন বাউফেল উপজেলার। এ বার্তা পাওয়ার পর আমরা সরেজমিনে সন্দেহভাজনের বাড়িতে গিয়েছিলাম কিন্তু ওই ব্যক্তি ও তার পরিবারের লোকজন এলাকায় আসেন না। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঢাকায় থাকেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ২৮ অক্টোবর আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুট করা হয়। এ ঘটনায় আদাবর থানায় একটি মামলা হয়। মামলায় ফয়সাল করিম মাসুদকে প্রধান আসামি করা হয়। ৭ নভেম্বর ফয়সাল করিম মাসুদকে র‍্যাব গ্রেপ্তার করে। এ সময় তার কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, পাঁচটি গুলি, তিনটি মোবাইল ফোন ও পাঁচ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।

প্রাইম সাসপেক্টকে খুঁজছি, হোপফুলি হিট করতে পারব- ডিএমপি কমিশনার : হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের খোঁজা হচ্ছে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, ‘আমরা প্রাইম সাসপেক্টকে খুঁজতেছি। হোপফুলি আমরা হিট করতে পারব। আমরা জনগণের সহযোগিতা চাইছি।’ গত শনিবার রাজধানীর রাজারবাগে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভায় বক্তব্য দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। শরিফ ওসমান বিন হাদির ওপর হামলার ঘটনায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনার বলেন, ‘তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

বেনাপোল সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতায় বিজিবি : হাদির ওপর গুলির ঘটনার পর বেনাপোল সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবি জানিয়েছে, হামলার ঘটনায় জড়িতরা যাতে বেনাপোল দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সীমান্তে নজরদারি ও তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়ন সূত্র জানায়, ব্যাটালিয়নের আওতাধীন প্রায় ৭০ কিলোমিটার সীমান্তে কঠোর নজরদারি শুরু হয়েছে। স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে টহল বাড়ানো হয়েছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশি করা হচ্ছে। গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি সীমান্তে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। যেসব এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নেই, সেসব পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে যাতে কেউ অবৈধভাবে পারাপার করতে না পারে। যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীরা যাতে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালাতে না পারে, সে জন্য বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্কাতায় রয়েছে। সীমান্তের সব পয়েন্টে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে।

এই হামলা বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত- প্রধান উপদেষ্টা : রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গত শুক্রবার উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য এবং আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি জরুরি বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী মো. সায়েদুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির হামলা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদকালে অন্যতম উদ্বেগজনক ঘটনা। এই হামলা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ওপর সুপরিকল্পিত আঘাত। এর মাধ্যমে পরাজিত শক্তি দেশের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। এই ধরনের হামলার চেষ্টাকে আমরা যেকোনো মূল্যে ব্যর্থ করে দিব। জাতির ওপর এই ধরনের অপশক্তির আঘাত কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। এই হামলার মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো অবস্থাতেই এই ধরনের ষড়যন্ত্রকে সফল হতে দিব না।

আঘাত যাই আসুক, যত ঝড়-তুফান আসুক, কোনো শক্তিই আগামী নির্বাচনকে বানচাল করতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের আপামর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের সম্মিলিত শক্তি দিয়ে জাতির জন্য একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করব।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যে করেই হোক দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাদির ওপর হামলা ও হামলার পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তার করতে হবে।’ তিনি দেশবাসীকে ওসমান হাদির দ্রুত আরোগ্য কামনায় মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করার আহ্বান জানান। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এরইমধ্যে হামলার স্থানের সিসিটিভি ফুটেজ ও অন্যান্য আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে সীমান্তে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘হামলাকারীরা যাতে কোনোভাবেই দেশ ছাড়তে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’

এ সময় তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার কারণে যারা সম্ভাব্য টার্গেটে পরিণত হয়ে থাকতে পারেন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, নির্বাচনকালীন যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে একটি বিশেষ হটলাইন নম্বর চালু করা হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সম্ভাব্য যেসব স্থানে অপরাধীরা লুকিয়ে থাকতে পারে সেখানে অভিযান জোরদারের সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত