ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে গণতন্ত্রের যাত্রা এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার

* শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদন * খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষে বিএনপির শ্রদ্ধা * মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে বিভিন্ন সংগঠন ও শ্রেণি-পেশার মানুষের শ্রদ্ধা
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে গণতন্ত্রের যাত্রা এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। গতকাল রোববার সকালে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রাজধানীর মিরপুরে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান তিনি। এ সময় ঘড়ির কাঁটায় সময় সকাল ৭টা ২২ মিনিট। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে প্রধান উপদেষ্টা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাবৃন্দ, ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। পাশাপাশি তিনি আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহিদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। একাত্তরের ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। স্বাধীনতার সূর্য ওঠার আগমুহূর্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা চালায়। এর আগে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন গতকাল সকাল আনুমানিক ৭টা ০৪ মিনিটে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিএনপির শ্রদ্ধা : দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। গতকাল রোববার সকালে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে মিরপুরে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ। তার পক্ষ থেকে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে আজ (গতকাল) আমরা শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এসেছি। শ্রদ্ধা জানিয়েছি।

বিএনপি মহাসচিব আশা প্রকাশ করে বলেন, আগামীতে তারেক রহমানের যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন, তা প্রতিষ্ঠিত হবে। সব চক্রান্ত উপেক্ষা করে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় বিএনপি এগিয়ে যাবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব আমানুল্লাহ আমান ও মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক প্রমুখ।

মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে বিভিন্ন সংগঠনের শ্রদ্ধা : ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, বিজয়ের আগ মুহূর্তে, জাতি হারায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। পরিকল্পিতভাবে রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশকে মেধাশূন্য করার নৃশংস চেষ্টা চালায়। সেই শোকাবহ স্মৃতি স্মরণে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর পালিত হয় শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে গতকাল রোববার সকাল ৭টার পর রাজধানীর মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর স্মৃতিসৌধ সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর একে একে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

দিবসটিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, মৎস্যজীবী দল (ঢাকা মহানগর উত্তর), ঢাকা মহানগর যুবদল, জাতীয়তাবাদী তাঁতী দল, জাতীয় যুবশক্তি, জাতীয় ছাত্রশক্তি, গণফোরাম, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ, ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও নাগরিক ঐক্যসহ বিভিন্ন সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

এছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে দলের নেতৃবৃন্দও শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযুদ্ধপন্থি লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ চিন্তাশীল মানুষদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়, যাতে বাংলাদেশ স্বনির্ভরভাবে দাঁড়াতে না পারে।’ তিনি বলেন, আজও নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান নস্যাৎ করতে পরিকল্পিত টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ঘটছে।

এসময় জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি। পাশাপাশি ১৯৭১, ১৯৪৭ ও ২০২৪ সালের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বানও জানান।

এছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী কৃষক দল, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, বাসদ (মার্কসবাদী), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, জাতীয় জনতা পার্টি, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, আমার বাংলাদেশ (এবি পার্টি), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল ও মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করেন।

শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধা : শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাজধানীর মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ১৪ ডিসেম্বর দিবসটি পালিত হয়। গতকাল রোববার সকাল ৭টার পর রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তাদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর, স্মৃতিসৌধ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

স্মৃতিসৌধ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সকালের দিকে মানুষের সমাগম কিছুটা কম থাকলেও, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। দলে দলে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, ছাত্রসংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ব্যানার ও স্লোগানসহ শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তৎপর ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিনিধি দল শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি বলেন, ‘শহিদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের ইতিহাসে চিরঅম্লান এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জোগায়।’

তিনি আরও বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণআন্দোলনে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের আত্মত্যাগেই আমাদের ঐতিহ্য ও জাতীয় পরিচয় রক্ষা করেছে। তিনি বলেন, আজ আমরা শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে বারবার এই ঐক্য ধরে রাখার গুরুত্ব উপলব্ধি করি। ইতিহাস আমাদের শেখায় যে, এই ঐক্যই আমাদের শক্তি ও বিপর্যয়ের সময়ে জাতিকে অটুট রাখে। বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবজায় রাখা আগের চেয়েও বেশি জরুরি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু), ভিপি সাদিক কায়েমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু), ঢাকা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), মিরপুর কলেজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দল, গণবিশ্ববিদ্যালয়, মহিলা পরিষদ, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি), বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

উল্লেখ্য, ১৪ ডিসেম্বরকে বুদ্ধিজীবীদের নিধনযজ্ঞের দিন হিসেবে স্মরণ করা হলেও, মূলত ১০ ডিসেম্বর ইতিহাসের এ ঘৃণ্যতম অপকর্মের সূচনা হয়। সপ্তাহজুড়ে এদের তালিকায় একে একে উঠে আসে বুদ্ধিদীপ্ত সাহসী মানুষের নাম। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ১০ ডিসেম্বর থেকেই রাতের আঁধারে তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে চোখ বেঁধে রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার মিরপুরে প্রথম শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। ১৯৯১ সালে ঢাকার রায়েরবাজারে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নামে আরেকটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ শুরু হয়, যা ১৯৯৯ সালের ১৪ই ডিসেম্বর উদ্বোধন করা হয়। প্রতি বছর, ১৪ ডিসেম্বর শোকের আবহে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়ে থাকে। এ দিন দেশের সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং উড়ে শোকের প্রতীক কালো পতাকা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত