ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলায় জাতিসংঘের নিন্দা

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলায় জাতিসংঘের নিন্দা

সুদানে জাতিসংঘের এক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় ছয় শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। তাঁরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘আমি সুদানের কাদুগলিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর লজিস্টিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে নৃশংস ড্রোন হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের লক্ষ্য করে হামলা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।’ সুদানের কোরদোফান অঞ্চলের কাদুগলি শহরে অবস্থিত জাতিসংঘের ভবনটিতে গত শনিবার এ হামলা হয়। গুতেরেসের বিবৃতিতে বলা হয়, হামলায় আরও আট শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন। হতাহত ব্যক্তিদের সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। তাঁরা ইউএন ইন্টারিম সিকিউরিটি ফোর্স ফর আবেইয়ের (ইউএনআইএসএফএ) হয়ে দায়িত্বরত ছিলেন। গুতেরেস বলেন, ‘দক্ষিণ কোরদোফানে আজ (শনিবার) শান্তিরক্ষীদের ওপর যে হামলা হয়েছে, তা অগ্রহণযোগ্য। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’

সুদানের সেনাবাহিনী ওই হামলার দায় র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) নামে দেশটির আধা সামরিক বাহিনীর ওপর চাপিয়েছে। সুদানে দুই বছরের বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। দেশটির সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে এ লড়াই চলছে। আরএসএফ তাৎক্ষণিকভাবে হামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

সুদানের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, এ হামলা বিদ্রোহী মিলিশিয়া এবং এর পেছনে যারা আছেন, তাদের ধ্বংসাত্মক কৌশলের স্পষ্ট প্রকাশ। সুদান সেনাবাহিনী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও পোস্ট করেছে। ভিডিওতে একটি স্থান থেকে ঘন কালো ধোঁয়া আকাশে উঠতে দেখা যাচ্ছে। তারা বলেছে, এটি জাতিসংঘের স্থাপনা।

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী হতাহত হওয়ার এ ঘটনায় গভীর শোক ও উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। যেখানে হামলা হয়েছে, সেই তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল আবেই নিয়ে সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। ২০১১ সালে সুদান থেকে আলাদা হয়ে দক্ষিণ সুদান একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর পর থেকে সেখানে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশন মোতায়েন রয়েছে।

গুতেরেস সুদানকে এখনই একটি যুদ্ধবিরতিতে উপনীত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানে গৃহযুদ্ধ চলছে। সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে ক্ষমতা দখলের এ লড়াই রাজধানী খার্তুম ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।

সংঘাতে এ পর্যন্ত ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, নিহত ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে সুদানের কোরদোফানকে ঘিরে মূল লড়াই হচ্ছে, বিশেষ করে আরএসএফ এল-ফাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর। পশ্চিমাঞ্চলের দারফুরে এটাই সুদান সেনাবাহিনীর সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটি ছিল। এ গৃহযুদ্ধ বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে এবং সুদানের কয়েকটি অঞ্চলকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সুদানে শান্তিরক্ষীদের ওপর এ হামলার মাত্র এক মাস আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইউএনআইএসএফএ শান্তি রক্ষা মিশনের মেয়াদ আরও এক বছরের জন্য নবায়ন করার পক্ষে ভোট দেয়। বিশ্বের যুদ্ধ ও সংঘাতকবলিত বিভিন্ন অঞ্চলে মোতায়েন জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের অন্যতম প্রধান অবদানকারী দেশ হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশি সেনারা দীর্ঘদিন ধরে আবেইয়ে মোতায়েন রয়েছেন।

হতাহত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের নামণ্ডপরিচয় জানাল আইএসপিআর : সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীদের ড্রোন হামলায় হতাহত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীদের নামণ্ডপরিচয় জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। গতকাল রোববার দুপুরে আইএসপিআরের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টে বলা হয়, সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক বেজে গতকাল শনিবার স্থানীয় সময় বেলা ৩টা ৪০ থেকে ৩টা ৫০ মিনিটের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী ড্রোন হামলা চালায়। এ হামলায় দায়িত্বরত ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী শহীদ হন। আর আটজন শান্তিরক্ষী আহত হন।

শহীদ শান্তিরক্ষীরা হলেন- করপোরাল মো. মাসুদ রানা, এএসসি (নাটোর), সৈনিক মো. মমিনুল ইসলাম, বীর (কুড়িগ্রাম), সৈনিক শামীম রেজা, বীর (রাজবাড়ী), সৈনিক শান্ত মন্ডল, বীর (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ), লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা)

আহত শান্তিরক্ষীরা হলেন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান, পিএসসি, অর্ডন্যান্স (কুষ্টিয়া), সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন, বীর (দিনাজপুর), করপোরাল আফরোজা পারভিন ইতি, সিগন্যালস (ঢাকা), ল্যান্স করপোরাল মহিবুল ইসলাম, ইএমই (বরগুনা), সৈনিক মো. মেজবাউল কবির, বীর (কুড়িগ্রাম), সৈনিক মোসা. উম্মে হানি আক্তার, ইঞ্জি. (রংপুর), সৈনিক চুমকি আক্তার, অর্ডন্যান্স (মানিকগঞ্জ), সৈনিক মো. মানাজির আহসান, বীর (নোয়াখালী)।

আইএসপিআরের পোস্টে বলা হয়, আহত আট শান্তিরক্ষীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে সৈনিক মেজবাউল কবিরের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ইতিমধ্যে তাঁর সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। আহত অপর সাতজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাঁরা সবাই শঙ্কামুক্ত রয়েছেন।

আইএসপিআরের পোস্টে বলা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। শহীদ শান্তিরক্ষীদের আত্মত্যাগ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অঙ্গীকারের এক উজ্জ্বল ও গৌরবময় নিদর্শন হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে শহীদদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হচ্ছে। আহত ব্যক্তিদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করা হচ্ছে।

৬ সেনা নিহতের ঘটনায় তারেক রহমানের শোক : সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীদের হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন শান্তিরক্ষী নিহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত শনিবার রাতে নিজের এক ফেসবুক পোস্টে এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এ ঘটনায় আরও আটজন শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন।

তারেক রহমান বলেন, সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর বর্বর হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন বীর শান্তিরক্ষীর শাহাদাত এবং তিনজন নারী সেনাসদস্যসহ আরও আটজনের আহত হওয়ার খবরে আমি গভীরভাবে মর্মাহত ও শোকাহত।

তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘের পতাকা তলে বিশ্বশান্তি রক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গকারী আমাদের বীর সেনাসদস্যরা জাতির গর্ব। তাদের এই আত্মত্যাগ বাংলাদেশের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমি নিহত শান্তিরক্ষীদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আহত সেনাসদস্যদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি এবং এই দুঃসময়ে তাদের পাশে থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও কার্যকর ভূমিকা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন সেনা কর্মকর্তার গর্বিত সন্তান হিসেবে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসাধারণ পেশাদারিত্ব, সাহস আর আত্মত্যাগ আমাকে সবসময় গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। চলমান পরিস্থিতিতে শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও কার্যকর ভূমিকা জরুরি বলে আমি মনে করি। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের বীর সেনাসদস্যদের শহিদ হিসেবে কবুল করুন এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য দান করুন।

সুদানে ৬ শান্তিরক্ষী নিহতের ঘটনায় জামায়াত আমিরের শোক : সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন শান্তিরক্ষী নিহত হওয়ায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি। বিবৃতিতে জামায়াত আমির বলেন, শনিবার আফ্রিকার সুদানের আবেই এলাকায় স্থানীয় সময় বিকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন। এতে ৬ জন শাহাদাত বরণ করেছেন এবং আরও ৮ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা মানবতার বিরুদ্ধে এক জঘন্য অপরাধ। আমি এই বর্বরোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। একই সঙ্গে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সৈন্যদের আত্মত্যাগে আমরা বীরের জাতি হিসেবে গর্বিত।

জামায়াত আমির বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের অধীনে বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত ও সংঘাতপূর্ণ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিষ্ঠা ও বীরত্বের সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে চলেছে। কম্বোডিয়া, সাবেক যুগোস্লাভিয়া, ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর, সিরেরালিওন, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদানসহ বিভিন্ন দেশে তারা চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে পেশাদারি ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হওয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাদের সাহস, ধৈর্য ও বীরত্ব আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মর্যাদা ও সুনাম আরও সুদৃঢ় করেছে। প্রকৃত অর্থেই, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’ এখন একটি ব্র্যান্ড নেম। ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভবিষ্যতেও দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

জামায়াত আমির নিহতদের রূহের মাগফিরাত এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। এছাড়া আহতদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি বিশ্বশান্তি মিশনে নিয়োজিত সৈন্যদের নিরাপত্তা আরও জোরদার করার জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্ববাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বানও জানান জামায়াত আমির।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত