ঢাকা সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৭ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার

ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য দান-সদকা। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কাউকে কিছু দান করার নাম সদকা। ইসলাম অর্থ-বিত্ত কুক্ষিগত করে না রেখে প্রাণ খুলে অভাবীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে বলে। দানে-বিসর্জনে গরিব-দুঃখী ও অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর প্রতি উৎসাহিত করে। ইসলামে দানের নির্দেশনা, সাহাবিদের দানের ঐতিহাসিক গল্প, দানের ইহকালীন-পরকালীন উপকারিতাসহ সদকার সঠিক পদ্ধতি বিষয়ে লিখেছেন- মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার

ইসলামে দান-সদকার নির্দেশ : পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে দান-সদকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে? (আল্লাহ বলেন) জানিয়ে দিন, যা তোমাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত।’ (সুরা বাকারা : ২১৯)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-খয়রাত বরবাদ করো না সেই ব্যক্তির মতো, যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। অতএব, এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মতো, যার ওপর কিছু মাটি পড়েছিল। অতঃপর এর ওপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল। তারা ওই বস্তুর কোনো সওয়াব পায় না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।’ (সুরা বাকারা : ২৬৪)। এ ছাড়া আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের সম্পদে নিঃস্ব ও অসহায়দের অধিকার রয়েছে।’ (সুরা জারিয়াত : ১৯)। অর্থাৎ আমরা যা দান করি, কোরআনের দৃষ্টিতে তা দয়া নয়; তা অসহায়দের অধিকার বা হক্কুল ইবাদ। আমরা যখন দান করি, তখন নিজের সৃষ্টির অধিকারকেই সম্মান করি। তখন স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ আমাদের সম্মানিত করবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক রয়েছে ভিক্ষুক এবং বঞ্চিত (অভাবী অথচ লজ্জায় কারো কাছে হাত পাতে না) সবার হক রয়েছে।’ (সুরা মাআরিজ : ২৪-২৫)।

সাহাবিদের দানের গল্প : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় সাহাবিরা ছিলেন বড় দানবীর। তারা আল্লাহর দ্বীনের জন্য, অভাবীদের অভাব দূর করতে ও ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ করতে দান করতেন। সচ্ছল-অসচ্ছল সর্বাবস্থায় দানের প্রতিযোগিতায় তারা ছিলেন অগ্রগামী। তাদের দানশীলতার কিছু নমুনা হলো-

আবু বকর (রা.)-এর দানশীলতা : যায়েদ ইবনে আসলাম (রহ.) তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন, ওমর (রা.)-কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাবুক যুদ্ধের সময় দান-সদকা করার জন্য আমাদের নির্দেশ দেন। সৌভাগ্যক্রমে ওই সময় আমার সম্পদও ছিল। ভাবলাম, যদি কোনোদিন আবু বকর (রা.)-কে অতিক্রম করে যেতে পারি, তাহলে আজই সেই সুযোগ। ওমর (রা.) বলেন, আমি আমার অর্ধেক সম্পদ নিয়ে এলাম। আর আবু বকর (রা.) ঘরের ঝাড়ু, চুলার ছাই থেকে নিয়ে ঘরের সব মালামাল গাট্টি বেঁধে নিয়ে এলেন। যখন আমাদের উভয়ের মাল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে রাখা হলো, তখন দেখা গেল, আমার মাল অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে, আর আবু বকর (রা.)-এর মাল খুবই কম। তখন আমি খুব খুশি হলাম। কেননা, আজকের দানের ব্যাপারে আমি জিতে গেছি। কিন্তু না, রাসুলুল্লাহ (সা.) সবকিছুই জানতেন। তাই তিনি জানতে চাওয়ার ধরন পাল্টে দিলেন। বললেন, ‘ওমর! তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য তুমি কী রেখে এসেছ?’ বললাম, ‘এর সমপরিমাণ সম্পদ।’ এরপর বললেন, ‘আবু বকর! তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য তুমি কী রেখে এসেছ?’ বললেন, ‘তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-কে রেখে এসেছি।’ এমন উত্তর শুনে ভাবলাম, আমি হয়তো কখনও আবু বকর (রা.)-কে অতিক্রম করতে পারব না। (তিরমিজি : ৩৬৭৫)।

ওমর (রা.)-এর দানশীলতা : আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ওমর (রা.) খায়বারে কিছু জমি লাভ করেন। তিনি এ জমির ব্যাপারে পরামর্শের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলেন। বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি খায়বারে এমন ভালো কিছু জমি লাভ করেছি, যা এর আগে আর কখনও পাইনি। সুতরাং আপনি আমাকে এ ব্যাপারে কী বলেন?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি চাইলে জমি ওয়াকফ করে উৎপাদিত ফসল সদকা করতে পার।’ আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ওমর (রা.) এ শর্তে তা ওয়াকফ করেন যে, তা বিক্রি ও দান করা যাবে না এবং কেউ এর উত্তরাধিকারীও হবে না। তিনি জমি থেকে উৎপন্ন বস্তু অভাবগ্রস্ত, আত্মীয়-স্বজন, দাসমুক্তি, আল্লাহর রাস্তায়, মুসাফির ও মেহমানদের জন্য খরচ করেন। (বোখারি : ২৭৩৭)।

ওসমান (রা.)-এর দানশীলতা : আবদুর রহমান (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, ওসমান (রা.) অবরুদ্ধ হলে তিনি সাহাবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আপনারা জানেন না যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, ‘যে ব্যাক্তি রুমার কুপটি খনন করে দেবে, সে জান্নাতি।’ আর আমি তা খনন করে দিয়েছি। আপনারা কি জানেন না যে, তিনি বলেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি তাবুক যুদ্ধের সেনাদের সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দেবে, সে জান্নাতি।’ আমি তার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। বর্ণনাকারী বলেন, ‘সাহাবিরা তার কথা সত্য বলে স্বীকার করলেন।’ (বোখারি : ২৭৭৮)।

কোরআনের বাণী- ‘যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে একমাত্র মহান রবের জন্য নিজের ধন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মতো; যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে ১০০ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা : ২৬১)। এ আয়াতের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ একটি ঘটনা আছে। তা হলো- আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতকালে একবার দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। খাদ্য দ্রব্য একেবারেই দুর্লভ হয়ে পড়ে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কঠিন আকার ধারণ করে। সে সময় ওসমান (রা.)-এর প্রায় এক হাজার মণ গমের একটি চালান বিদেশ থেকে মদিনায় পৌঁছে। শহরের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী ওসমান (রা.)-এর কাছে এলেন। তারা তার সব গম ৫০ শতাংশ লাভে কেনার প্রস্তাব দিলেন। সেই সঙ্গে এ প্রতিশ্রুতিও দিলেন যে, তারা দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণের দুর্দশা লাঘবের জন্যই এ গম কিনতে চায়। ওসমান (রা.) বললেন, ‘তোমরা যদি আমাকে এক হাজার গুণ লাভ দিতে পার, তবে আমি দিতে পারি। কেননা, অন্য একজন আমাকে সাতশ গুণ দিতে চেয়েছেন।’ ব্যাবসায়ীরা বলল, ‘চালান মদিনায় আসার পর তো আমরাই প্রথম এলাম আপনার কাছে। তাহলে সাতশ গুণ লাভের প্রস্তাব কে কখন দিয়েছে?’ বললেন, ‘এ প্রস্তাব আমি আল্লাহর কাছ থেকে পেয়েছি। আমি এ চালানের সব গম বিনামূল্যে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করব। এর বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা আমাকে সাতশ গুণ বেশি পুণ্য দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’ তখন ওসমান (রা.) কোরআনের উল্লিখিত আয়াতটি স্মরণ করিয়ে দিলেন।

দান-সদকার প্রকার : সদকা দুই প্রকার- ১. সাধারণ সদকা ও ২. সদকায়ে জারিয়া। গরিব-দুঃখীকে টাকা-পয়সা দান করা, ভালো ব্যবহার করা সাধারণ সদকার অন্তর্ভুক্ত। আর সদকায়ে জারিয়া বলা হয় ওইসব সৎকর্মকে, যেগুলোর কল্যাণকারিতা স্থায়ী হয়। এর মধ্যে সর্বাগ্রে হচ্ছে- দ্বীনি ইলম শিক্ষা দান, দ্বীনি বইপুস্তক রচনা ও প্রকাশ করে সর্বসাধারণের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ। কারণ, দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে মানবসন্তানের জন্য সর্বাধিক কল্যাণকর বিষয় হচ্ছে- আল্লাহর সঙ্গে, তাঁর বিধিবিধানের সঙ্গে এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে পরিচিতি লাভ। এক ব্যক্তি অন্যকে যদি দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেন, সে নিজে আমল করবে এবং প্রত্যক্ষভাবে হোক বা পরোক্ষভাবে, পরবর্তী সময়ে কাউকে না কাউকে শিক্ষা দেবে। এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত এ সৎকাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই ব্যক্তিকে সর্বাপেক্ষা বড় দাতারূপে আখ্যায়িত করেছেন, যিনি পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর ইলম অন্যদের শিক্ষা দেন। তার পরের স্থান মসজিদ, এতিমখানা, মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট, সেতু-পুকুর ইত্যাদি গণকল্যাণমূলক খাতে দান করা। এসবের দ্বারা অনেক বেশি লোক উপকৃত হন এবং তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায়, তিনটি আমল ছাড়া তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। তা হলো- সদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান অথবা সৎকর্মশীল সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম শরিফ : ১৬৩১) ইমাম নববি (রহ.) এ হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলেন, ‘সদকায়ে জারিয়া হলো ওয়াকফ।’ (শরহে মুসলিম : ১১/৮৫)।

সদকার ইহকালীন উপকারিতা : দান-সদকার অনেক ফজিলত ও ইহকালীন-পরকালীন উপকারিতা রয়েছে। ইহকালীন উপকারিতার মধ্যে যেমন-

রিজিকে বরকত আসে : দান-সদকা অভাব দূর করে। সম্পদ বাড়িয়ে দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মতো, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে। প্রত্যেক শীষে একশ শস্যদানা। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ সর্বব্যাপী প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা : ২৬১)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল কামাই থেকে একটি খেজুর পরিমাণ সদকা করবে (আল্লাহ তা কবুল করবেন) এবং আল্লাহ শুধু পবিত্র মাল কবুল করেন, আর আল্লাহ তাঁর ডান হাত দিয়ে তা কবুল করেন। এরপর আল্লাহ দাতার কল্যাণার্থে তা প্রতিপালন করেন; যেমন- তোমাদের কেউ অশ্বশাবক প্রতিপালন করে থাকে। অবশেষে সেই সদকা পাহাড় সমান হয়ে যায়। (বোখারি : ১৪১০)।

মানুষকে পরিশুদ্ধ করে : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী, তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদকা নিয়ে তাদের পাক-পবিত্র করুন, (নেকির পথে) তাদের এগিয়ে দিন এবং তাদের জন্য রহমতের দোয়া করুন।’ (সুরা তাওবা : ১০৩)। এখানে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধুকে উদ্দেশ করে সদকার মাধ্যমে তার উম্মতদের পরিশুদ্ধ করে নিতে বলছেন। তাফসিরবিদরা এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন, সদকা আখলাক-চরিত্র পরিশুদ্ধ করার অন্যতম মাধ্যম। (তাফসিরে ইবনে কাসির)।

পাপ মোচন হয় : দান-সদকার মাধ্যমে পাপের বোঝা হালকা হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান কর, তবে তাও উত্তম। আর যদি গোপনে কর এবং তা অভাবগ্রস্তদের দান কর, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম। অধিকন্তু তিনি তোমাদের কিছু গোনাহ মোচন করে দেবেন। বস্তুত যা কিছু তোমরা করছ, আল্লাহ তার খবর রাখেন।’ (সুরা বাকারা : ২৭১)।

ফেরেশতাদের দোয়া পাওয়া যায় : যারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় দান করে, তাদের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিদিন সকালে দুজন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন। অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন।’ (বোখারি : ১৪৪২)।

দানের পরকালীন উপকারিতা : সদকার ইহকালীন উপকারিতার মতো পরকালীনও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা রয়েছে। যেমন-

আরশের ছায়াতলে আশ্রয় : যারা গোপনে দান করবেন, মহান আল্লাহ কঠিন কেয়ামতের দিন তাদের আরশের ছায়াতলে স্থান দেবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যেদিন আল্লাহর (রহমতের) ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা তাঁর নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। তারা হলো- ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক, ২. সেই যুবক, যার জীবন গড়ে উঠেছে তার প্রতিপালকের ইবাদতের মধ্যে, ৩. সেই ব্যক্তি, যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে, ৪. সেই দুই ব্যক্তি, যারা পরস্পরকে ভালোবাসে আল্লাহর জন্য, একত্র হয় আল্লাহর জন্য এবং পৃথকও হয় আল্লাহর জন্য, ৫. সেই ব্যক্তি, যাকে কোনো উচ্চ বংশীয় রূপসী নারী আহ্বান জানায়, কিন্তু সে এ বলে প্রত্যাখ্যান করে- ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি।’ ৬. সেই ব্যক্তি, যে এমন গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত যা খরচ করে, বাঁ হাত তা জানে না, ৭. সেই ব্যক্তি, যে নির্জনে আল্লাহর জিকির করে, ফলে তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইতে থাকে।’ (বোখারি : ৬৬০)।

জাহান্নাম থেকে মুক্তি : মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করলে জাহান্নাম থেকে মুক্তির আশা করা যায়। কেননা, রাসুলুল্লাহ (সা.) জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বেশি বেশি সদকা করার তাগিদ দিয়েছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত; একবার ঈদুল আজহা অথবা ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদগাহের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি নারীদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, ‘হে নারীসমাজ, তোমরা সদকা করতে থাক। কারণ, আমি দেখেছি, জাহান্নামের অধিবাসীদের মধ্যে তোমরাই বেশি।’ তারা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কারণে হে আল্লাহর রাসুল?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা বেশি পরিমাণে অভিশাপ দিয়ে থাক আর স্বামীর অকৃতজ্ঞ হও।’ (বোখারি : ৩০৪)।

দান-সদকা যাদের করা যাবে : যাদের দান করা যাবে, এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে তালিকা দেওয়া হয়েছে। তা হলো- ‘জাকাত হলো শুধু ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এ হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা তাওবা : ৬০)। এ আয়াত দ্বারা ফকিহরা মোট আট শ্রেণির লোকদের দান করার কথা বলেছেন- ১. গরিব; যার সম্পদ আছে, কিন্তু নেসাব পরিমাণ মালের মালিক নয়। ২. মিসকিন; যার একদমই কোনো সম্পদ নেই। ৩. ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য শরিয়ত নির্দিষ্ট জাকাত আদায়কারী আমল। এটা ইসলামি রাষ্ট্রপ্রধান দ্বারা নিযুক্ত হতে হবে। নিজে নিজে মনে করে নিলে হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিকহ : ৬/৬৯)। ৪. নওমুসলিমদের ইসলামের প্রতি আকর্ষণের জন্য উৎসাহমূলক জাকাত প্রদান। এ বিধানটি রহিত হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে কোনো ধনী নওমুসলিমকে জাকাত দেওয়া জায়েজ নয়। (হেদায়া : ১/১৮৪; তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন : ৪/১৭১; তাফসিরে মাজহারি : ৪/২৩৫)। ৫. দাসমুক্তির জন্য; যেহেতু বর্তমানে দাসপ্রথা নেই। তাই এ খাতটি বাকি নেই। ৬. ঋণগ্রস্তের জন্য। ৭. ফি সাবিলিল্লাহ তথা আল্লাহর রাস্তায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য। ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, এতে রয়েছেন- জিহাদরত মুজাহিদরা। তাদের জিহাদের অস্ত্র ও পাথেয় ক্রয় করার জন্য জাকাতের টাকা গ্রহণ করবে। হজের সফরে থাকা দরিদ্র ব্যক্তির জন্য। ইলমে দ্বীন অর্জনকারী দরিদ্র ব্যক্তির জন্য। (আদ্দুররুল মুখতার : ৩৪৩; হেদায়া : ১/১৮৫; তাফসিরে রুহুল মাআনি : ৬/৩১৩)। ৮. সফররত ব্যক্তিকে। যার টাকা-পয়সা আছে বাড়িতে। কিন্তু সফর অবস্থায় অসহায়। তাকে জাকাতের টাকা দেওয়া জায়েজ।

যেভাবে দান করলে সওয়াব হয় : ইসলামের অপরাপর আমলের মতো দানের জন্যও রয়েছে কিছু দিকনির্দেশনা। যদি দানের ক্ষেত্রে সেগুলো রক্ষা করা হয়, তাহলে এর যথাযথ প্রতিদান পাওয়া যাবে। দানের সওয়াব বহু গুণে বেড়ে পরকালে আমাদের সামনে উপস্থিত হবে। সেগুলো হলো-

নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া : বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোনো আমলেরই আল্লাহর কাছে মূল্য নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তি তা-ই পাবে, যার নিয়ত সে করবে।’ (বোখারি : ১; মুসলিম : ১৯০৭)। দানের ব্যাপারেও একই কথা। দান করতে হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তবেই তা পরকালে বর্ধিত হয়ে দাতার হাতে ফিরে আসবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ এবং নিজেদের মধ্যে পরিপক্কতা আনার জন্য সম্পদ ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত হলো, কোনো টিলার ওপর একটি বাগান রয়েছে, তার ওপর প্রবল বৃষ্টিপাত হলো, ফলে দ্বিগুণ ফল জন্মাল। যদি তাতে প্রবল বৃষ্টি না-ও পড়ে, তবে হালকা বৃষ্টিও (তার জন্য যথেষ্ট)। তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ তা অতি উত্তমরূপে দেখেন।’ (সুরা বাকারা : ২৬৫)। কিন্তু নিয়ত যদি শুদ্ধ না হয়, তখন হিতে বিপরীতও হতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সম্পদশালীকে আল্লাহর সামনে হাজির করা হবে। আল্লাহ তাকে যেসব নেয়ামত দান করেছেন, তার সামনে পেশ করা হবে। দেখে সে চিনে ফেলবে। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, এগুলোতে তুমি কী আমল করেছ? সে বলবে, যেসব খাতে দান করা আপনি পছন্দ করেন, এমন প্রতিটি খাতেই আপনার জন্য খরচ করেছি। তাকে ডেকে বলা হবে, মিথ্যা বলেছ! তোমাকে দানবীর বলার জন্য তুমি খরচ করেছ। তা বলা হয়ে গেছে। অতঃপর তাকে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম : ১৯০৫; মুসনাদে আহমদ : ৮২৭৭)। তাই অল্প হোক বা বেশি, দান হতে হবে আল্লাহর জন্য। বিশুদ্ধ নিয়তে সামান্য দানও যদি করা হয়, সেটি মৃত্যুর পরে কাজে আসবে। এমনকি যদি নিজের হালাল উপার্জন থেকে স্ত্রী ও পরিবারের জন্য খরচ করা হয়, তাও বিফলে যাবে না। বিনিময়ে আল্লাহ সদকার সওয়াব দেবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যা-ই খরচ করবে, তার প্রতিদান দেওয়া হবে; এমনকি স্ত্রীর মুখে খাবারের লোকমা তুলে দিলেও।’ (মুসলিম : ১৬২৮; সহিহ ইবনে হিব্বান : ৪২৪৯)।

হালাল অর্থ থেকে দান করা : হালাল সম্পদ থেকে দান করতে হয়। অন্যথায় সেই দান কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা যা কিছু উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা কিছু উৎপন্ন করেছি, তার উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ থেকে একটি অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর।’ (সুরা বাকারা : ২৬৭)। মোমিন যদি ইখলাসের সঙ্গে হালাল সম্পদ থেকে আল্লাহর পথে খরচ করে, আল্লাহ নিজ দায়িত্বে সেটির প্রতিদান বাড়িয়ে দেন। কেয়ামতের দিন বান্দার হাতে তা বহুগুণে বাড়িয়ে তুলবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করল, আল্লাহ তা উত্তমভাবে গ্রহণ করেন। অতঃপর তা লালন-পালন করে বড় করতে থাকেন; যেমন- তোমরা ঘোড়ার বাচ্চা লালন-পালন কর; একপর্যায়ে এ সামান্য দান পাহাড়সম হয়ে যায়।’ (বোখারি : ১৪১০; মুসলিম : ১০১৪)।

পছন্দনীয় জিনিস দান করা : আজ যা দান করা হচ্ছে, পরকালের জন্যই তা আল্লাহর কাছে রেখে দেওয়া হচ্ছে। বীজের জন্য মানুষ ভালো ফসলটাই রেখে দেয়, যাতে নতুন করে বীজ বোনা যায়। কাজেই মোমিনের উচিত, হাতে থাকা সম্পদ থেকে উত্তমটাই আল্লাহর কাছে গচ্ছিত রাখা। নিজের পছন্দের জিনিসটি আল্লাহর পথে খরচ করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা কিছুতেই পুণ্য লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় কর।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯২)। রবী ইবনে খুসাইম (রহ.)-এর সম্পর্কে নুসাইর (রহ.) বলেন, কোনো ভিখারী এলে রবী ইবনে খুসাইম (রহ.) বলতেন, ‘তাকে চিনি দাও।’ কারণ, রবী চিনি পছন্দ করতেন। (আয-যুহদ হান্নাদ ইবনুস সারি : ১/৩৪৪)।

সাধ্য অনুযায়ী অল্প হলেও দান করা : আল্লাহর পথে দান করার জন্য কাড়ি কাড়ি অর্থ লাগে না। যার যতটুকু আছে, সাধ্যের ভেতর থেকে দান করা চাই। ইখলাসের সঙ্গে হালাল রিজিক থেকে দান করলে সামান্য অর্থও আল্লাহ গ্রহণ করবেন। বিনিময়ে পাহাড়সম নেকি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘খেজুরের এক টুকরো (সদকা করে) হলেও জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা কর।’ (বোখারি : ১৪১৭; মুসলিম : ১০১৬)।

কল্যাণ ও ন্যায়ের পথে দান করা : যে খাতে দান করলে অর্থটা ভালো কাজে খরচ হয়, যার মাধ্যমে ঈমান-আমল বা দ্বীনি বা মানবিক প্রয়োজন পূরণ হয়, সেসব ক্ষেত্রে দান করা চাই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা কর।’ (সুরা মায়িদা : ২)। দানের জন্য রয়েছে গরিব-দুঃখী, বিধবা-অসহায়, এতিমণ্ডমিসকিন, মসজিদণ্ডমাদ্রাসা, ওয়াজ-মাহফিল বা অন্য যে কোনো দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন দাওয়াতি কার্যক্রম। তা না করে যদি গাঁটের পয়সা খরচ করা হয় (নাচণ্ডগান, আড্ডা, খেল-তামাশা ইত্যাদি) কোনো পাপের পথে, তখন এ দান নিজের কল্যাণ তো দূরের কথা, অনেক ক্ষতি ও দুর্গতি ডেকে আনে। ইবনে হাজার হায়তামি (রহ.) বলেন, ‘কোনো সগিরা গোনাহের পথেও যদি এক টাকা খরচ করা হয়, সেটিও কবিরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।’ (আয-যাওয়াজির আন ইকতিরাফিল কাবাইর : ১/৪২১)। তাই আল্লাহতায়ালা নিষেধ করেছেন, ‘তোমরা গোনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করো না।’ (সুরা মায়িদা : ২)।

ভারসাম্য রক্ষা করে দান করা : ঈমান-আমল থেকে শুরু করে সব কর্ম ও আচরণে ভারসাম্য শেখায় ইসলাম। দানের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ না করে সব নিজের হাতে কুক্ষিগত করতে যেমন নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি নিজের সব অর্থ-সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে নিজেকেই অন্যের কাছে হাত পাততে বা পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে কষ্ট হয়, এমনটি ইসলাম পছন্দ করে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণরূপে খুলে রেখ না; যার কারণে তোমাকে নিন্দাযোগে ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়তে হয়।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৯)। আল্লাহতায়ালা জান্নাতিদের বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘ব্যয় করার সময় যারা অপব্যয় এবং কার্পণ্য করে না; বরং তা হয় ভারসাম্যপূর্ণ।’ (সুরা ফোরকান : ৫৭)। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর মুমূর্ষু অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে দেখতে যান। সাদ (রা.) বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহতায়ালা আমাকে অঢেল ধন-সম্পদ দান করেছেন। আমার সন্তান বলতে মাত্র একটি মেয়ে। আমি চাচ্ছি, আমার সম্পদের তিন ভাগের দুই ভাগ দ্বীনের জন্য খরচ করব।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অনুমতি দিলেন না। তিনি আরেকটু কম করে বললেন, ‘তাহলে অর্ধেক সম্পত্তি দান করার অসিয়ত করি?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) এরও অনুমতি দিলেন না। তিনি আরও কম করে বললেন, ‘তাহলে আমার মোট সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ দ্বীনের জন্য অসিয়ত করে যাই?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) এবার কিছুটা সম্মত হলেন। বললেন, ‘আচ্ছা, দিতে পার; কিন্তু তিন ভাগের এক ভাগও অনেক।’ এরপর বললেন, ‘তুমি তোমার সন্তান-সন্ততিকে দরিদ্র অবস্থায় রেখে যাবে আর তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে, এর চেয়ে অনেক উত্তম হচ্ছে, তাদের সচ্ছল অবস্থায় রেখে যাওয়া।’ (বোখারি : ৪৪০৯)।

গোপনে দান করা বেশি ভালো : চুপি চুপি দান করা চাই, যেন কোনো ধরনের আত্মমুগ্ধতা বা আত্মপ্রচারের শিকার হতে না হয়। ডান হাত দিয়ে দান করলে বাঁ-হাতও যেন টের না পায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সাত ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো, যে এমনভাবে দান করে, ডান হাতে দান করলে বাঁ-হাতও টের পায় না।’ (বোখারি : ১৪২৩)। তবে কখনও গোপনে দান করার চেয়ে প্রকাশ্যে দানেও অনেক কল্যাণ থাকে। যেমন- দানের মাধ্যমে অন্যদের উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা; এটাও যে দানের একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত, সেদিকে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। প্রকাশ্যে দান করা মানেই মন্দ নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান-সদকা কর, তাও ভালো। আর যদি গোপনে গরিবদের দান কর, তবে তা কতোই না শ্রেয়।’ (সুরা বাকারা : ২৭১)।

প্রকৃত হকদারকে দান করা : কিছু লোক অর্থ সংকটের শিকার হয়েও ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য ও সামাজিক অবস্থানের কারণে চক্ষুলজ্জায় কারও কাছে চায় না। দান করার সময় খুঁজে খুঁজে এমন লোকদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা যেহেতু অতি সংযমী হওয়ায় কারও কাছে চায় না, তাই অনবগত লোকে তাদেরকে বিত্তবান মনে করে। তোমরা তাদের চেহারার আলামত দ্বারা তাদের (অভ্যন্তরীণ অবস্থা) জানতে পারবে।’ (সুরা বাকারা : ২৭৩)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এক-দুই লোকমা খাবার বা এক-দুটি খেজুরের জন্য যে মানুষের দ্বারে দ্বারে ধর্না দেয়, অভাবী তো সে নয়; প্রকৃত অভাবী হলো, যার অভাব আছে, কিন্তু তাকে দেখে তার অভাব আঁচ করা যায় না; যার ভিত্তিতে মানুষ তাকে দান করবে। আবার চক্ষুলজ্জায় সে মানুষের দুয়ারে হাতও পাততে পারে না।’ (বোখারি : ১৪৭৯; মুসলিম : ১০৩৯)।

নিকটবর্তী লোকদের দান করা : নিজের নিকটাত্মীয়দের আগে দান করা চাই। এতে একদিকে যেমন সদকার সওয়াব মেলে, তেমনি আত্মীয়তার হকও আদায় হয়ে যায়। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি উৎসাহিত করেছেন। একে দ্বিগুণ সওয়াব লাভের মাধ্যম বলেছেন। তিনি বলেন, ‘মিসকিনকে দান করলে শুধু দান করার সওয়াব লাভ হয়। আর আত্মীয়-স্বজনকে দান করলে দুটি সওয়াব- দান করার সওয়াব এবং আত্মীয়তার হক আদায়ের সওয়াব।’ (তিরমিজি : ৬৫৮; মুসনাদে আহমদ : ১৬২৩৩)। তবে সবসময় অন্য গরিব-দুঃখীদের এড়িয়ে শুধু নিকটজনদের দান করা নয়, কখনও হতে পারে নিকটাত্মীয়ের চেয়ে অন্যদের অভাব ও প্রয়োজনটা বেশি। দান করার সময় তাদের প্রতিও লক্ষ্য রাখা উচিত।

খোঁটা বা অন্য কোনোভাবে কষ্ট দিয়ে দান নষ্ট না করা : দানের পরে খোঁটা দিতে নেই। অন্যথায় সেটি পরকালে দানকারীর জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। বানে ভেসে যাওয়া খড়-কুটার মতো হারিয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! খোঁটা ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদকাকে সেই ব্যক্তির মতো নষ্ট কোরো না, যে মানুষকে দেখানোর জন্য নিজের সম্পদ ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত হলো, মসৃণ পাথরের ওপর মাটি জমে আছে, অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে (সেই মাটিকে ধুয়ে নিয়ে যায়) এবং (পুনরায়) মসৃণ পাথর বানিয়ে দেয়। এরূপ লোক যা উপার্জন করে, তার কিছুই তারা হস্তগত করতে পারে না।’ (সুরা বাকারা : ২৬৪)।

স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বপ্রণোদিত হয়ে দান করা : সদকা আল্লাহর ক্রোধকে নিভিয়ে দেয়। অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। তাই শুধু বিপদে নয়, বরং সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সর্বাবস্থায় দান করা উচিত। আল্লাহতায়ালা মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল (সর্বাবস্থায় আল্লাহর জন্য অর্থ) ব্যয় করে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩৪)। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; এক লোক এসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, ‘কখন দান করা উত্তম?’ তিনি বললেন, ‘যখন তুমি (অতি প্রয়োজন বা লোভের কারণে) মাত্রাতিরিক্ত মিতব্যয়ী বা হাড়কিপটে হও এবং সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করো অথবা সুস্থাবস্থায় দীর্ঘায়ুর প্রত্যাশা কর, তখন সদকা করা। এত দেরি করো না যে, মৃত্যু এসে পড়ে আর তখন তুমি (অসিয়ত করে) বলছ, আমার সম্পদগুলো অমুকের জন্য, অমুকের জন্য। অথচ (তুমি না বললেও) তা তাদের জন্যই হয়ে আছে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৯৭৬৮; সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৭০৬)।

নিজ প্রয়োজনে আপন দায়িত্বে দান করা : দানের মাধ্যমে গ্রহীতার প্রতি অনুগ্রহ করা হচ্ছে, এমন ধারণা করা বোকামি; বরং তার প্রাপ্য ও অধিকারটাই তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যাদের সম্পদে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের নির্ধারিত হক রয়েছে।’ (সুরা মাআরিজ : ২৪-২৫)। কোরআনে কারিমে একে তাদের ‘হক’ বলা হয়েছে। সুতরাং দানকারীর মানসিকতা থাকবে, দান নিজ প্রয়োজনে করলাম। গ্রহীতা তা গ্রহণ করে আমার প্রতি করুণা করল।

লেখক : শিক্ষক, সম্পাদক, অনুবাদক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত