ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দু’হাত তুলে দোয়া করা

ড. মুহাম্মদ বিন সালেহ মুনাজ্জিদ
দু’হাত তুলে দোয়া করা

নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন তার কাছে চাওয়াটা এবং সবকিছু তার থেকে প্রত্যাশা করা। যে ব্যক্তি তার কাছে চায় না, তিনি তার ওপর রাগ করেন। তিনি তার বান্দাদের তার কাছে চাওয়া বা প্রার্থনা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আর তোমাদের রব বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ (সুরা গাফির : ৬০)। আমরা অনেকেই ভুলে যাই, দোয়া নিজেই একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। নবী (সা.) বলেন, ‘দোয়াই ইবাদত।’ (তিরমিজি : ৩৩৭২)।

দোয়ার আদবগুলো

১. দোয়াকারীকে আল্লাহর রুবুবিয়্যত, উলুহিয়্যত ও আসমা-সিফাতের প্রতি একত্ববাদী হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক দোয়া কবুল করার শর্ত হচ্ছে বান্দা কর্তৃক আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে নেক কাজ করা ও গোনাহ পরিত্যাগ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আমার বান্দারা যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (তখন বলে দিন যে) নিশ্চয় আমি অতি কাছে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে আমি তার আহ্বানে সাড়া দিই।’ (সুরা বাকারা : ১৮৬)।

২. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তাদের শুধু এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তারই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে।’ (সুরা বায়্যিনা : ০৫)। দোয়া যেহেতু ইবাদত, তাই ইখলাস দোয়া কবুলের শর্ত।

৩. আল্লাহর সুন্দর নাম ও গুণাবলি উল্লেখ করে তাঁকে ডাকা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব, তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাক; আর যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদের বর্জন কর।’ (সুরা আরাফ : ১৮০)।

৪. দোয়া করার আগে আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করা। ফোযালা বিন উবায়দ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে নামাজ আদায় করল, এরপর দোয়া করল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মাফ করে দাও, তুমি আমাকে রহম কর।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেনÑ হে নামাজি! তুমি বেশ তাড়াহুড়া করে ফেললে। তুমি নামাজ আদায় করে যখন বসবে তখন আগে আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করবে, আমার ওপর দরুদ পড়বে। এরপর আল্লাহর কাছে দোয়া করবে।’ (তিরমিজি : ৩৪৭৬)। এর পরের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে : ‘যখন তোমাদের কেউ নামাজ শেষ করবে, তখন আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি শুরু করবে। এরপর নবী (সা.) এর ওপর দরুদ পড়বে। অতঃপর যা ইচ্ছা দোয়া করবে।’ বর্ণনাকারী বলেন : এরপর অপর এক লোক নামাজ আদায় করল। সে ব্যক্তি আল্লাহর প্রশংসা করল, নবী (সা.) এর ওপর দরুদ পড়ল। তখন নবী (সা.) বললেন : ‘ওহে নামাজি! দোয়া কর, আল্লাহ তোমার দোয়া কবুল করবেন।’ (তিরমিজি : ২৭৬৭)।

৫. নবী (সা.) এর ওপর দরুদ পড়া। নবী (সা.) বলেন, ‘নবী (সা.) এর ওপর দরুদ না পড়া পর্যন্ত যে কোনো দোয়া আটকে থাকে।’ (সহিহুল জামে : ৪৩৯৯)।

৬. কিবলামুখী হয়ে দোয়া করা। উমর বিন খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বদর যুদ্ধের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) মুশরিকদের দিকে তাকালেন; তাদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। আর তাঁর সাথিবর্গের সংখ্যা ছিল ৩১৯। তখন তিনি কিবলামুখী হয়ে হাত প্রসারিত করলেন, তারপর তাঁর রবকে ডাকতে শুরু করলেন : ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে ওয়াদা দিয়েছেন সেটা বাস্তবায়ন করে দিন। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটা দান করুন। হে আল্লাহ! আপনি যদি মুসলমানদের এ দলটিকে ধ্বংস করে দেন, তাহলে পৃথিবীতে আপনার ইবাদত হবে না।’ এভাবে দুই হাত প্রসারিত করে কিবলামুখী হয়ে তাঁর রবকে ডাকতে থাকলেন; এমনকি এক পর্যায়ে তাঁর কাঁধ থেকে চাদরটি পড়ে গেল...। (মুসলিম : ১৭৬৩)।

ইমাম নববি (রহ.) ‘শারহু মুসলিম’ গ্রন্থে বলেন, এ হাদিসে দোয়াকালে কিবলামুখী হওয়া ও দুই হাত তুলে দোয়া করা মুস্তাহাব হওয়ার পক্ষে প্রমাণ রয়েছে।

৭. দুই হাত তোলা। সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আপনাদের সুমহান রব হচ্ছেন লজ্জাশীল ও মহানদাতা। বান্দা যখন তার কাছে দু’হাত তোলে তখন তিনি সে হাতদ্বয় শূন্য ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।’ (আবু দাউদ : ১৩২০)।

৮. আল্লাহর প্রতি এ একিন রাখা যে, আল্লাহ দোয়া কবুল করবেন এবং মনোযোগ দিয়ে দোয়া করা। নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা দোয়া কবুল হওয়ার একিন নিয়ে দোয়া কর। জেনে রাখ, আল্লাহ তায়ালা অবহেলাকারী ও অমনোযোগী অন্তরের দোয়া কবুল করেন না।’ (তিরমিজি : ৩৪৭৯)।

৯. বারবার চাওয়া। বান্দা আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর যা ইচ্ছা তা চাইবে, কাকুতি-মিনতি করবে, তবে দোয়ার ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া করবে না। কেননা নবী (সা.) বলেন : ‘বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা কোনো পাপ নিয়ে কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দোয়া করে। বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করে। জিজ্ঞেস করা হলো : ইয়া রাসুলুল্লাহ! তাড়াহুড়া বলতে কী বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন : বলে যে, আমি দোয়া করেছি, আমি দোয়া করেছি; কিন্তু আমার দোয়া কবুল হতে দেখিনি। তখন সে ব্যক্তি উদ্যম হারিয়ে ফেলে এবং দোয়া ছেড়ে দেয়। (বোখারি : ৬৩৪০)।

১০. দৃঢ়তার সঙ্গে দোয়া করা। কেননা নবী (সা.) বলেন : ‘তোমাদের কেউ যেন অবশ্যই এভাবে না বলে যে, হে আল্লাহ! আপনি যদি চান আমাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি যদি চান আমাকে দয়া করুন। কেননা নিশ্চয় আল্লাহর ওপর জবরদস্তি করার কেউ নেই।’ (বোখারি : ৬৩৩৯)।

১১. অণুনয়-বিনয়, আশা ও ভয় প্রকাশ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের রবকে ডাক’ [সুরা আরাফ : ৫৫]। তিনি আরও বলেন : ‘তারা সৎকাজে প্রতিযোগিতা করত, আর তারা আমাদের ডাকত আগ্রহ ও ভীতির সঙ্গে এবং তারা ছিল আমাদের কাছে ভীত-অবনত।’ [সুরা আম্বিয়া : ৯০]। তিনি আরও বলেন : ‘আর আপনি আপনার রবকে নিজ মনে স্মরণ করুন সবিনয়ে, ভীতচিত্তে ও অনুচ্চ স্বরে, সকালে ও সন্ধ্যায়।’ [সুরা আরাফ : ২০৫]।

১২. তিনবার করে দোয়া করা। আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন প্রার্থনা করতেন, তখন তিনবার করতেন।’ (বোখারি : ২৪০)।

১৩. ভালো খাবার ও ভালো পোশাক গ্রহণ করা (ভালো হতে হলে হালাল হওয়া জরুরি)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘হে লোকসব! নিশ্চয় আল্লাহ ভালো। তিনি ভালো নয়, এমন কিছু গ্রহণ করেন না। তিনি রাসুলদের যে নির্দেশ দিয়েছেন একই নির্দেশ মোমিনদের প্রতিও জারি করেছেন। তিনি বলেন : ‘হে রাসুলরা! আপনারা ভালো খাবার গ্রহণ করুন এবং নেক আমল করুন। নিশ্চয় আপনারা যা কিছু আমল করেন সে সম্পর্কে আমি সম্যক অবগত।’ [সুরা মুমিনুন : ৫১]। তিনি আরও বলেন : ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের যেসব ভালো রিজিক দিয়েছি সেগুলো থেকে খাও।’ [সুরা বাকারা : ১৭২]। এরপর তিনি উল্লেখ করেন, এক ব্যক্তি লম্বা সফর করে উশকোখুশকো চুল নিয়ে ধূলিমলিন অবস্থায় দুই হাত আকাশের দিকে তুলে দোয়া করে: ইয়া রব, ইয়া রব! অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, সে পরিপুষ্ট হয়েছে হারাম খেয়ে, তাহলে তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?’ (মুসলিম : ১০১৫)।

ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ‘হালাল খাওয়া, হালাল পান করা, হালাল পরিধান করা ও হালাল খেয়ে পরিপুষ্ট হওয়া দোয়া কবুল হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত।’

১৪. গোপনে দোয়া করা, শব্দ না করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের রবকে ডাক।’ [সুরা আরাফ : ৫৫]। আল্লাহ তায়ালা জাকারিয়া (আ.) এর প্রশংসা করে বলেন : ‘যখন তিনি তার রবকে ডেকেছিলেন নিভৃতে।’ [সুরা মারিয়াম : ০৩]।

আরবি থেকে অনুবাদ : মুহাম্মদ নুরুল্লাহ তারীফ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত