জীবন আল্লাহ তায়ালার মহান দান। পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সমন্বয়ে একটি উপভোগ্য হায়াত তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে আমাদের মূল উদ্দেশ্য কী হবে, সেটিও জানিয়ে দিয়েছেন। মানব জাতি প্রেরণের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সৎ আমল করা, গোনাহ পরিত্যাগ করা। হালাল গ্রহণ করা, হারাম বর্জন করা। ইসলামের প্রতিটি বিধান পূর্ণাঙ্গরূপে পালন করা। আল কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি মানুষ ও জিন জাতিকে শুধু এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে।’ (সুরা জারিয়াত : ৫৬)।
কিন্তু জীবনসন্ধ্যায় একদিন আমাদের বিদায় নিতে হবে। বিখ্যাত শক্তিধর পরাক্রমশালী ব্যক্তিকেও পরকালের যাত্রা করতে হয়েছে। জীব মাত্রই মৃত্যুর কাছে অসহায়। মৃত্যু থেকে কেউ কখনও পলায়ন করতে সক্ষম হয়নি। মোমিন বান্দার জন্য দুনিয়া হলো আখেরাত উৎপাদন ক্ষেত্র। আখেরাত কর্মক্ষেত্র নয়, ফলাফল ময়দান। মৃত্যুর পর মানুষের কোনো আমল করার সুযোগ থাকে না। অথচ তখন মানুষ সবচেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী হয় নেক আমলের। মৃত্যুর কারণে আমলের সুযোগ রুদ্ধ হয়ে গেলেও ইসলাম মৃত ব্যক্তির আমলনামায় সওয়াব পৌঁছানোর সুযোগ অবারিত রেখেছে। পৌঁছানোর দায়িত্ব জীবিতদের। জীবিতদের ওপর মৃত ব্যক্তি অবশ্যই অধিকার রাখে। মৃতদের মাগফিরাতের লক্ষ্যে সওয়াব প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জীবিতদের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে সওয়াব প্রেরণের বিভিন্ন পদ্ধতির কথা বর্ণিত হয়েছে। কয়েকটি পদ্ধতি নিম্নরূপ :
মাগফিরাতের দোয়া করা
পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘এবং দোয়া করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৪)।
অপর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করে দিন এবং আমার পিতা-মাতাকেও এবং প্রত্যেক এমন ব্যক্তিকেও, যে ঈমানের অবস্থায় আমার ঘরে প্রবেশ করেছে আর সব মোমিন পুরুষ ও মোমিন নারীকেও। আর যারা জালেম তাদের শুধু ধ্বংসই বৃদ্ধি করুন।’ (সুরা নুহ : ২৮)।
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতে কোনো ব্যক্তির সম্মান বৃদ্ধি করা হলে সে ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করবে, কী কারণে আমার মর্যাদা বৃদ্ধি ঘটল? তাকে উত্তর দেওয়া হবে, তোমার সন্তান কর্তৃক তোমার জন্য মাগফিরাতের দোয়ার বদৌলতে।’ (বোখারি, জানাজা অধ্যায়)।
জনকল্যাণমূলক কাজ
আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সাতটি কাজ এমন যেগুলোর সওয়াব বান্দা মৃত্যুর পর কবরে পেতে থাকে। নদী ও পানির কূপ খনন, গাছ রোপণ, যাত্রী ছাউনি নির্মাণ ইত্যাদি।’ (শুআবুল ঈমান, জাকাত অধ্যায়)।
দান-সদকা করা
আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি আমলের সওয়াব চালু থাকে। সদকায়ে জারিয়া, কোরআন-হাদিসের উপকারী ইলম ও নেককার সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম, অসিয়ত অধ্যায়)।
অপর একটি হাদিসে আছে, এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার পিতা সম্পদ রেখে ইন্তেকাল করেছেন। অথচ আমাকে কোনো অসিয়ত করে যাননি। তার পক্ষ থেকে সদকা করলে কি তার গোনাহ মাফ হবে? নবী করীম (সা.) উত্তর দিলেন, হ্যাঁÑ মাফ হবে।’ (নববিকৃত শরহু সহিহিল মুসলিম)।
মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ ও ধর্মীয় জ্ঞান বিস্তারে সহযোগিতা করা
আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মৃত্যুর পরও মানুষ এ কাজগুলোর সওয়াব পেতে থাকে। ইলম শেখা ও ইলমের প্রচার, মসজিদ নির্মাণ ইত্যাদি।’ (ইবনে মাজাহ, ঈমান অধ্যায়)।
ঋণ পরিশোধ করা
ইবনে আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণিত, সাদ ইবনে উবাদা (রা.) নবী করিম (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, আমার মাতা ইন্তেকাল করেছেন অথচ তার জিম্মায় মানত রয়েছে। এখন আমি কী করব? নবী করিম (সা.) বললেন, তার পক্ষ থেকে তুমি আদায় করে দাও।’ (ইবনে মাজাহ, সদকা অধ্যায়)।
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মোমিনের অন্তর নিজের ঋণের সঙ্গে ঝুলন্ত থাকে। পরিশোধ করার পরই তার মুক্তি মেলে।’ (সুনানে তিরমিজি, জানাজা অধ্যায়)।
এটা শরিয়ত স্বীকৃত বিষয় যে, মৃতদের উদ্দেশে জীবিত ব্যক্তি কর্তৃক সম্পাদন করা বিভিন্ন মৌখিক ও দৈহিক ইবাদতের সওয়াব মৃত ব্যক্তি পেয়ে থাকেন। আমর ইবনে শুআইব তার দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি নিজ মৃত পিতার পক্ষ থেকে গোলাম আজাদ করার অনুমতি চাইলে নবী করিম (সা.) উত্তরে বললেন, তোমার পিতা যদি মুসলিম হয়ে থাকে, তাহলে তার পক্ষ থেকে গোলাম আজাদ করতে পার, সদকা করতে পার অথবা হজ করতে পার। এগুলোর সওয়াব তাকে পৌঁছে দেওয়া হবে।’ (শরহুস সাবি)।
আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘নবী করিম (সা.) কোরবানির ইচ্ছা করলে দুটি মোটা, বড়, শিংবিশিষ্ট ভেড়া ক্রয় করতেন। একটি মুসলিম উম্মতের পক্ষে কোরবানি করতেন, আরেকটি নিজের এবং পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানি করতেন।’ (বায়হাকি)।
আবু মাসউদ আনসারি (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে কোনো সৎকাজ শেখায়, দ্বিতীয় ব্যক্তি ওই কাজ করলে প্রথম ব্যক্তি তার সওয়াব পেতে থাকে।’ (মুসলিম, নেতৃত্ব অধ্যায়)।
উপরোক্ত আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, নেক আমলের সওয়াব মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে প্রেরণ করা যায়। এর সওয়াব মৃত ব্যক্তি পেয়ে থাকেন। তাদের উপকার হয়। জীবিতদের কর্তব্য হলো, মৃত্যুর পর নিজেদের জন্য চলমান পাথেয় হিসেবে উল্লিখিত আয়াত ও হাদিসে যেসব নেক আমলের কথা বিধৃত হয়েছে সেগুলোর প্রতি মনোযোগী হওয়া। সঙ্গে সঙ্গে মৃত যেসব পরিজন, আত্মীয়, প্রতিবেশী ইন্তেকাল করে কবরে শায়িত, তাদের জন্যও উপরোক্ত আমলগুলো বাস্তবায়ন করে তাদের সওয়াব পৌঁছানো।
লেখক : খতিব, আল-মক্কা জামে মসজিদ হরপাড়া, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ