কেয়ামতের দিন বান্দাদের অবস্থান হবে ভয়াবহ। পরিস্থিতি হবে উদ্বেগজনক আর অবস্থা হবে ভীতিকর। ‘শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, ফলে আসমান ও জমিনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন। অতঃপর আবার শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দ-ায়মান হয়ে দেখতে থাকবে।’ (সুরা জুমার : ৬৮)।
মানুষকে সমবেত করা হবে নাঙা পা, শূন্য বদন ও খতনাবিহীন অবস্থায়। প্রত্যেকের সঙ্গে থাকবে একজন করে চালক ও সাক্ষী। যিনি তাকে পরিচালনা করবেন এবং তার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবেন। সেদিন মানবম-লীর মধ্যে কেউ হাসবে ও আনন্দ করবে। আবার কেউ কাঁদবে ও মৃত্যু কামনা করবে। নিজের আমলনামা নেবে কেউ ডান হাতে, কেউ বাম হাতে আবার কেউ পেছন দিক থেকে। সেদিন দয়াময়ের কাছে আল্লাহভীরুদের সমবেত করা হবে অতিথিরূপে। পক্ষান্তরে পাপী-অপরাধীদের জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে পিপাসার্ত অবস্থায়। ‘যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে, তার হিসাব-নিকাশ সহজে হয়ে যাবে।’ (সুরা আল-ইনশিকাক : ৭-৮)। খুশি ও আনন্দে সে বলবে : ‘নাও, তোমরাও আমার আমলনামা পড়ে দেখ। আমি জানতাম যে, আমাকে হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে।’ (সুরা আল-হাক্কা : ১৯-২০)।
পক্ষান্তরে ‘যাকে তার কর্মলিপি তার পিঠের পেছনে দেওয়া হবে, সে মৃত্যুকে আহ্বান করবে।’ (সুরা আল-ইনশিকাক : ১০-১১)। আফসোস-পরিতাপের সঙ্গে বলতে থাকবে : ‘হায় আমায় যদি আমার আমলনামা না দেওয়া হতো। আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব!’ (সুরা আল-হাক্কা : ২৫-২৬)।
ঈমানদার ভাইয়েরা, ওই হাজির হওয়ার দিনে আমলের নিত্তি স্থাপন করা হবে। এটি হবে আক্ষরিক অর্থেই একটি নিক্তি। যার থাকবে দুটি পাল্লা। পাপ ও পুণ্যের ওজনে এটি ঝুঁকবে। জ্ঞান এর আকার অনুমান করতে পারে না। মস্তিষ্ক একে কল্পনা করতে পারে না। এটি মাপ করবে ছোট-বড় সব কিছু। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেন : ‘আমলের নিক্তি-পাল্লা সত্য। এর দ্বারা পাপ-পুণ্য মাপা হবে। আল্লাহ যেমন চাইবেন সেভাবে।’ আল্লাহ বলেন : ‘আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না। যদি কোনো আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট।’ (সুরা আল-আম্বিয়া : ৪৭)।
কোরআন ও সুন্নাহর বাণী প্রমাণ করে যে বান্দা, তার কর্ম ও কর্মের ফিরিস্তিপত্র কেয়ামতের দিন সবগুলোই দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মাপা হবে। মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : ‘কেয়ামতের দিন পাল্লা স্থাপন করা হবে। এক ব্যক্তিকে এনে একটি পাল্লায় রাখা হবে। তারপর তার সমুদয় কর্মকে রাখা হবে। তাকে নিয়ে পাপের পাল্লা ভারী হয়ে যাবে। বর্ণনাকারী বলেন : তারপর তাকে জাহান্নামের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। যখন তাকে নিয়ে জাহান্নামের দিকে মুখ করবে, দয়াময় আল্লাহর কাছ থেকে একজন চিৎকার করে বলে উঠবে তাড়াহুড়ো করো না, তাড়াহুড়ো করো না। তার তো আরও আমল বাকি আছে। তারপর একটি চিরকুট আনা হবে, যেখানে লেখা আছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। এবার ওই লোকটিসহ এটিকে এক পাল্লায় রাখা হবে। তখন তাকেসহ নেকির পাল্লা ভারী হয়ে যাবে।’
এই আমলের পাল্লায় বান্দার ওজন দৈহিক বিশালতা দিয়ে নয়, কম-বেশ হবে তার ঈমান ও আমলের কম-বেশি অনুপাতে। যেমন সহিহ বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : ‘কেয়ামতের দিন (জাহান্নামিদের মধ্য থেকে) একজন বিশালাকার মোটা ব্যক্তি আসবে। কিন্তু সে আল্লাহর কাছে মশার ডানার চেয়েও ক্ষুদ্র হবে। তারপর তিনি বলেন, পাঠ করো, ‘কেয়ামতের দিন তাদের কাজের কোনো গুরুত্ব রাখব না।’ (সুরা কাহফ : ১০৫)। হাদিসে আছে একদিন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জন্য আরাক গাছের মিসওয়াক সংগ্রহ করে আনছিলেন। আর তার পায়ের গোছা ছিল সরু ও পাতলা। সেটি বাতাসে উড়তে দেখে সাহাবিরা হাসতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন : তোমরা কেন হাসছ? তারা বললেন : হে আল্লাহর নবী, তার পায়ের হালকা গোছা দেখে। নবী (সা.) বললেন : সে সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তার পা দুটি মিজানের পাল্লায় ওহুদ পাহাড়ের চেয়ে বেশি ভারী হবে। (বর্ণনায় ইমাম আহমাদ)।
মোমিন ভাইয়েরা, কেয়ামতের ভয়াবহতার অন্যতম হলো আমল পরিমাপের এই পর্ব। এর ভয়াবহতায় বান্দার বুক শুকিয়ে যাবে। চোখে যেন সরিষার ফুল দেখবে। ভুলে যাবে আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবদের। সামনে যা করুণ অবস্থা দেখতে, সে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সে দেখবে তার কর্মের ফসল। ফলে ভীতি কাটতে চাইবে না। যতক্ষণ না দেখবে তার আমলের পাল্লা ভারী না হালকা? যার আমলের পাল্লা ভারী হবে, তাকে শুরু-শেষের পুরো মানবম-লীর সম্মুখে ডেকে এনে বলা হবে: ‘সবাই দেখ, অমুকের সন্তান অমুক আজ এমন সৌভাগ্য অর্জন করেছে, যার পর আর কখনও তাকে দুর্ভাগ্য স্পর্শ করবে না।’ আর যদি তার আমলের পাল্লায় নেকি হালকা হয়, তাহলে তামাম মানুষের সামনে তাকে ডেকে বলা হবে : ‘অমুকের সন্তান অমুক আজ এমন দুর্ভাগ্য অর্জন করেছে, যার পর আর কখনও সে সৌভাগ্য হাসিল করতে পারবে না।’
সুনান আবি দাউদে বর্ণিত হয়েছে একদিন আয়েশা (রা.) জাহান্নামের কথা স্মরণ করে কাঁদতে লাগলেন। (তাকে দেখে) রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কাঁদছ কেন? আয়েশা (রা.) বললেন : জাহান্নামের কথা স্মরণ হওয়ায় আমি কাঁদছি। (হে আল্লাহর নবী) আপনি কি কেয়ামতের দিন আপনার পরিবার-পরিজনের কথা মনে রাখবেন? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন : তিনটি স্থান এমন আছে, যেখানে কেউ কারও কথা স্মরণ করবে না। যথা ১। মিজান বা মাপের সময়, যতক্ষণ না কেউ জানতে পারবে, তার পাল্লা ভারী না হালকা, ২। কিতাব বা আমলনামা পাওয়ার সময়, যখন বলা হবে দৌড়ে এসো এবং নিজ নিজ আমলনামা পাঠ কর। যতক্ষণ কেউ জানতে পারবে না যে, তা কোন দিক থেকে আসে ডান, বাম না পেছনের দিক থেকে এবং ৩। সে সময় যখন সে পুলসিরাতের ওপর থাকবে এবং তা জাহান্নামের ওপর রাখা হবে। ‘অতঃপর যখন শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে, সেদিন তাদের পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না এবং একে অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে না। যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই হবে সফলকাম এবং যাদের পাল্লা হাল্কা হবে তারাই নিজেদের ক্ষতিসাধন করেছে, তারা দোজখেই চিরকাল বসবাস করবে।’ (সুরা আল-মুমিনুন : ১০১-১০৩)।
এই উম্মতের ওপর আল্লাহর খাস রহমতের একটি দিক হলো তাদের রাসুল (সা.) কে কেয়ামতের ভয়াবহ ও বীভৎস সময়ে উপস্থিত রাখবেন, যাতে করে তিনি নিজ উম্মতের জন্য সুপারিশ করতে পারেন। (সুনান তিরমিজি)। আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘আমি নবী (সা.) কে কেয়ামতের দিন আমার জন্য শাফায়াত করার প্রার্থনা জানিয়েছিলাম। তিনি বললেন : আমি তা করব। বললাম : ইয়া রাসুলাল্লাহ, কোথায় আমি আপনাকে তালাশ করব? তিনি বললেন : প্রথমে তুমি তালাশ করবে সিরাতে। বললাম : যদি সিরাতে আপনার সাক্ষাৎ না পাই? তিনি বললেন : তুমি আমাকে মিজানে তালাশ করবে। বললাম : যদি মিজানে আপনার তালাশ না পাই? তিনি বললেন : আমাকে হাউসে কাউসারে তালাশ করবে। এই তিনটি স্থানে আমি হারাব না।’ অর্থাৎ এই তিন স্থানের কোনোটাতে অবশ্যই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবেই।
কেয়ামতের ওই কঠিন লগ্নে নবীজি (সা.) এর শাফায়াতের সৌভাগ্য লাভ করবে সবচেয়ে বেশি তাওহিদ ও খাঁটি ঈমানসম্পন্ন লোকরা। নিজ বান্দাদের প্রতি আল্লাহর দয়ার এও একদিক যে, তিনি কিছু আমল আমাদের দিয়েছেন, যা আমলনামায় অনেক ওজনদার হবে। তাওহিদের পর এসব আমলের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে উত্তম আখলাক। উত্তম আখলাক একেবারে সহজ বিষয় হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও কোমল ভাষা। আর সবচেয়ে বেশি লোক যার মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করবে তা এই উত্তম আখলাক। এর মাধ্যমে তাহাজ্জুদগুজার ও রোজাদারের মর্যাদা লাভ হয়। বরং উত্তম আখলাকের অধিকারী কেয়ামতের দিন নবীজি (সা.) এর সবচেয়ে প্রিয় ও নৈকট্যপ্রাপ্ত হবেন। কেন নয়, তিনি তো ছিলেন মানুষের মধ্যে আখলাকে সবচেয়ে পরিপূর্ণ। অপরকে সম্মান দেওয়া, হাসি মুখে কথা বলা, অন্তরে দয়ার প্রকাশ, চরিত্রে কোমলতা, ক্ষমায় প্রশস্ততায় ছিলেন সবার সেরা। নবী (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন (নেকি) ওজন করার দাঁড়িপাল্লায় সচ্চরিত্রের চেয়ে কোনো বস্তুই অধিক ভারী হবে না।’ (তিরমিজি)।
আমলনামাকে ওজনদার বানানোর আরেক বড় আমল মৃতের জানাজা ও দাফনে শরিক হওয়া। বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : ‘যে ব্যক্তি মৃতের জন্য (জানাজার) নামাজ আদায় করা পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে, তার জন্য এক কিরাত (সওয়াব), আর যে ব্যক্তি মৃতের দাফন হয়ে যাওয়া পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে তার জন্য দুই কিরাত (সাওয়াব)। জিজ্ঞাসা করা হল দুই কিরাত কি? তিনি বললেন, দুটি বিশাল পর্বত সমতুল্য।’
যে কেউ তার আমলনামাকে ভারী করতে চাইলে সে যেন বেশির চেয়ে বেশি আল্লাহর তাসবিহ ও তাহমিদ করে। সুবহানাল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ জিকির করে। যেমন সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : ‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক; আলহামদুলিল্লাহ (সব প্রশংসা শুধু আল্লাহর জন্য) [বললে] পাল্লা পরিপূর্ণ করে দেয় এবং ‘সুবহানাল্লাহ ওয়াল-হামদুলিল্লাহ্ (আল্লাহ কতই না পবিত্র! এবং সব প্রশংসা শুধু আল্লাহর জন্য) উভয়ে অথবা এর একটি আসমান ও জমিনের মাঝখান পূর্ণ করে দেয়। দুটি কলেমা (বাণী) রয়েছে, যেগুলো দয়াময় আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়, উচ্চারণে খুবই সহজ (আমলের) পাল্লায় অত্যন্ত ভারী। (বাণী দুটি হচ্ছে), ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহান্নাল্লাহিল আজিম’ আমরা আল্লাহ তায়ালার প্রশংসাসহ তার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, মহান আল্লাহ অতীব পবিত্র।’
জুওয়াইরিয়াহ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন : রাসুলুল্লাহ (সা.) ভোরবেলা ফজরের সালাত আদায় করে তার কাছে থেকে বের হলেন। ওই সময় তিনি সালাতের স্থানে বসা ছিলেন। এর পর তিনি চাশতের পরে ফিরে এলেন। এ অবস্থায়ও তিনি উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি বললেন, আমি তোমাকে যে অবস্থায় ছেড়ে গিয়েছিলাম তুমি সে অবস্থায়ই আছ। তিনি বললেন, হ্যাঁ। নবী (সা.) বললেন, আমি তোমার কাছে থেকে রওনার পর চারটি কালেমা তিনবার পড়েছি। আজকে তুমি এ পর্যন্ত যা বলেছ তার সঙ্গে ওজন করা হলে এ কালেমা চারটির ওজনই ভারী হবে। কালেমাগুলো এই ‘সুবহা-নাল্লা-হি ওয়াবি হামদিহি আদাদা খল্কিহি ওয়া রিযা- নাফসিহি ওয়াযিনাতা আরশিহি ওয়ামি দা-দা কালিমা-তিহি’, অর্থাৎ ‘আমি আল্লাহর প্রশংসার সঙ্গে তার পবিত্রতা বর্ণনা করছি তার মাখলুকের সংখ্যার পরিমাণ, তার সন্তুষ্টির পরিমাণ, তার আরশের ওজন পরিমাণ ও তার কালেমাগুলোর সংখ্যার পরিমাণ।’ (বর্ণনায় মুসলিম)।
অতএব, সৌভাগ্য তার মিজানে, যার নেকির পাল্লা ভারী হবে। আফসোস তার জন্য, যার আমলনামা হালকা হবে। আল্লাহ বলেন : ‘আর সেদিন যথার্থই ওজন হবে। অতঃপর যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই সফলকাম হবে এবং যাদের পাল্লা হাল্কা হবে, তারাই এমন হবে, যারা নিজেদের ক্ষতি করেছে। কেননা, তারা আমার আয়াতগুলো অস্বীকার করত।’ (সুরা আল-আ’রাফ : ৮-৯)।
২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪২ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর
আলী হাসান তৈয়ব