সম্প্রতি জেন্ডার ট্রান্সফরমেশন বা লিঙ্গ পরিবর্তনের একটি ঘটনা মিডিয়ায় ঘটা করে প্রচার হচ্ছে, যা প্রকারন্তরে এই অপ্রাকৃতিক কাজটিকে প্রমোট করছে। এ বিষয়ে ইসলাম কী বলে সেটা প্রত্যেক মুসলিমের জানা উচিত। এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেনÑ ঢাকা সানইবোর্ডের জামিয়াতু ইবরাহিমের সিনিয়র মুহাদ্দিস আল্লাহ মানুষকে সুন্দরতম অবকাঠামোতে সৃষ্টি করেছেন। পুরুষ ও নারী প্রত্যেককেই তার উপযোগী বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ অবকাঠামো দান করেছেন। ‘নিশ্চই আমি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা তীন : ৪)।
মানবজাতির সৃষ্টির সূচনা থেকেই মানবজাতিকে আল্লাহ দু’দলে বিভক্ত করেছেন। নারী-পুরুষ মিলেই পূর্ণ হয়েছে মানবসভ্যতা। উভয়কে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টি করেছেন। দুই লিঙ্গের শারীরিক গঠনের মতো মানসিকতায়ও তফাৎ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এরা একই রক্তে-মাংসে গড়া। এদের থাকা ও চলাফেরা একই রকম। একই মানুষের সামান্য নাপাক পানি থেকে জন্ম। অথচ এ দুইয়ের মধ্যে রয়েছে কণ্ঠে, শক্তিতে ও জ্ঞানে তারতম্য। এমনকি চালচলনেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বিজ্ঞানীদের এক দলের গবেষণায় দুই লিঙ্গের মস্তিষ্কের কাঠামো, মস্তিষ্কের আয়তন ও কর্মক্ষমতায়ও পার্থক্য প্রমাণিত।
মানব সৃষ্টির এ রহস্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এক সত্তা (আদম) থেকে; আর তা থেকে তৈরি করলেন তার জোড়া (হাওয়া) এবং এতদ্বয় থেকে বিস্তৃত করলেন বহু পুরুষ ও নারী।’ (সুরা নিসা : ১)। অন্য সুরায় এসেছে এভাবে, ‘আর নিশ্চয় তিনি সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায় পুরুষ ও নারী।’ (সুরা নাজম : ৪৫)।
শুধু যৌনাঙ্গ দিয়ে নারী-পুরুষ নির্ধারিত হয় না। দৃশ্যমান যৌনাঙ্গ ছাড়াও গুপ্ত কিছু যৌন ব্যাপারও রয়েছে, যা পুরুষ-নারী উভয়ের সম্পূর্ণ আলাদা। আল্লাহ অঙ্গগুলো তৈরি করেছেন নারী-পুরুষে স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টির জন্য।
যাতে উভয়ে তাদের স্বাভাবিক কাজের যোগ্য হয় এবং নিজ নিজ দায়িত্ব আদায়ে সক্ষম হয়। তাই উভয়ের দেহের হরমোনে বড় পার্থক্য বিদ্যমান। আরও রয়েছে দেহের বিভিন্ন কাঠামোগত পার্থক্য।
জেন্ডার ট্রান্সফরমেশন বা লিঙ্গ রূপান্তরের বাস্তবতা
লিঙ্গ পুনর্নির্ধারণ বা লিঙ্গ রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসলে একজন মানুষ বিপরীত লিঙ্গের মতো হয়ে ওঠার জন্য বাহ্যিক অঙ্গগুলোতে পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু ভেতরগত লৈঙ্গিক পরিবর্তন হয় না। সত্যিকারে একজন মানুষ বিপরীত লিঙ্গের হয়ে যায় না।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা লিঙ্গ রূপান্তরের বাস্তব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, অপারেশনের মাধ্যমে পুরুষ যৌনাঙ্গের অধিকারী ব্যক্তির লিঙ্গ ও অ-কোষ অপসারণ করা হয়। অ-কোষের অবশিষ্টাংশের সঙ্গে একটি ছোট কৃত্রিম যোনি স্থাপন করা হয়। কখনও কখনও কৃত্রিম স্তনও স্থাপন করা হয়। পাশাপাশি এ ব্যক্তিকে প্রচুর পরিমাণে মেয়েলি হরমোন দেওয়া হয়, যেন কণ্ঠটি নরম হয় এবং দেহে ফ্যাট তৈরি হয়ে নারীর দেহের প্রাথমিক কিছু বৈশিষ্ট্য তার শরীরে দৃশ্যমান হয়। এতে করে বাহ্যিক আকৃতিতে তিনি নারী হন; কিন্তু বাস্তবে তিনি পুরুষই থাকেন। শুধু তার যৌনাঙ্গের কাঠামোটি রূপান্তর করা হয়েছে। কারণ তার ডিম্বাশয় বা জরায়ু নেই। তার ঋতুস্রাবও হয় না। সর্বোপরি তার পক্ষে গর্ভধারণ করা আদৌ সম্ভব নয়।
একই বিষয় নারীর বেলায়ও। অপারেশনের মাধ্যমে তার যৌনাঙ্গের কাঠামোটি পরিবর্তন করা হয়। জরায়ু এবং ডিম্বাশয় অপসারণ করা হয়। যোনি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং পরিবর্তে একটি কৃত্রিম লিঙ্গ স্থাপন করে, যা প্রয়োজনের সময় উরুতে স্থাপন করা ব্যাটারির সাহায্যে উত্থিতও হয়। পাশাপাশি দুটি স্তনও অপসারণ করা হয় এবং এই মহিলাকে প্রচুর পরিমাণে পুরুষ হরমোন দেওয়া হয়। যার ফলে তার কণ্ঠ অনেকটা পুরুষ কণ্ঠের মতো এবং গোঁফ ও চুল অনেকটা পুরুষের মতো হয়। এর সঙ্গে পুরুষ হরমোন সেবন এবং ব্যায়ামের প্রভাবে তার পেশিশক্তি বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে এ নারী বাহ্যিক আকৃতিতে অনেকটা পুরুষের মতো হয়ে যায়। কৃত্রিম লিঙ্গের সাহায্যে এ ব্যক্তি সহবাসও করতে পারে, তবে সে বীর্যপাত করতে পারে না। তার শরীরে শুক্রাণু তৈরি হয় না। আর তার জন্য সন্তান জন্ম দেওয়া একেবারেই অসম্ভব।
সুতরাং এ বিষয়টি স্পষ্ট, রূপান্তরের এ প্রক্রিয়াটি যতই নিখুঁত হোক না কেন, এটি একজন পুরুষকে পুরোপুরি মহিলা বা বিপরীতে রূপান্তর করতে সক্ষম হয় না। বরং এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন একটি ‘অদ্ভুত শরীর’ তৈরি হয়, যা না পুরুষ না নারী। যার পক্ষে পুরুষ-নারী কারও দায়িত্বই সম্পূর্ণরূপে সম্পাদন করা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি এতে নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ঝুঁকি তো আছেই।
জেন্ডার ট্রান্সফরমেশন বিষয়ে ইসলাম
সমকালীন সব নির্ভরযোগ্য আলেমের মতে, সাধারণ অবস্থায় জেন্ডার ট্রান্সফরমেশন বা লিঙ্গ রূপান্তরের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম। সুতরাং কোনো নর-নারীর জন্য অস্ত্রোপচার অথবা বিপরীত লিঙ্গের হরমোন সেবনের দ্বারা লিঙ্গ রূপান্তর করা বৈধ নয়। কারণ আল্লাহ মানুষকে তার প্রকৃতি অনুসারে সৃষ্টি করেছেন। আর আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করা একটি বড় পাপ ও শয়তানের অনুসরণ। পাশাপাশি এর মাধ্যমে পুরুষ নারীর বেশ ধারণ করে আর নারী-পুরুষের বেশ ধারণ করে। এটিও ইসলামে চূড়ান্তভাবে হারাম।
আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘শয়তান (আল্লাহকে) বলেছিল : আমি অবশ্যই আপনার বান্দাদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট অংশকে নিয়ে নেব এবং আমি তাদের সরল পথ থেকে নিশ্চিতভাবে পথভ্রষ্ট করব, তাদের আশ্বাস দেব; তাদের আদেশ দেব, তারা অবশ্যই পশুদের কর্ণ ছেদন কবে এবং তাদের আদেশ দেব তারা অবশ্যই আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করবে। যে কেউ আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়।’ (সুরা নিসা : ১১৭-১২১)।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) নারীর বেশধারী পুরুষ আর পুরুষের বেশধারী নারীকে অভিসম্পাত করেছেন।’ (বোখারি : ৫৫৪৬)। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) নারীর বেশধারী পুরুষ ও পুরুষের বেশধারী নারীর প্রতি অভিসম্পাত করেছেন।’ (আবু দাউদ : ৪০৯৮)।
সুতরাং একজন মুসলমান হিসেবে প্রত্যেকেরই কর্তব্য হলো, আল্লাহ তাকে যে লিঙ্গের জন্য নির্বাচন করেছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকা। ভিন্ন কিছু চিন্তা না করা। এরশাদ হচ্ছে, ‘নভোম-ল ও ভূম-লের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা, সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা তাদের দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল।’ (সুরা শূরা : ৪৯-৫০)।
বিশেষ অবস্থার অবকাশ
অনেকেই মানবাধিকারের মোড়কে জেন্ডার ট্রান্সফরমেশন/লিঙ্গ রূপান্তরের বিষয়টি প্রচার করেন। তাদের যুক্তি হলো, অনেক মানুষ তাদের জন্মগত লিঙ্গের প্রতি ঘৃণা বোধ করেন এবং বিপরীত লিঙ্গের হয়ে উঠতে চান। সুতরাং এ সুযোগ তাকে দেওয়া উচিত। এটি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও তার অধিকার। বস্তুত এটি একটি মানসিক রোগ। যার অবশ্যই চিকিৎসা করা উচিত। এটি নানা কারণে হতে পারে। হতে পারে অতীতের কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা, যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতন অথবা নিজ লিঙ্গ সম্পর্কে নেতিবাচক বা ভুল ধারণা থেকে। তাই এই ব্যক্তির এ সমস্যাটি সমাধানের জন্য অবশ্যই মানসিক চিকিৎসা নিতে হবে। জেন্ডার ট্রান্সফরমেশন/লিঙ্গ রূপান্তর এর সামাধান নয়।
ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির সঙ্গে সামাজিক আচরণ কীভাবে
শরিয়ার অনেক বিধান পুরুষ ও নারী তথা লিঙ্গের শ্রেণিভিত্তিক বিভাজিত। বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসের বহু বর্ণনা দ্বারা স্পষ্টতই বোঝা যায়, আল্লাহ মানব সমাজকে নারী ও পুরুষ দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। তৃতীয় লিঙ্গ ইসলামে নেই। সুতরাং হিজড়াদের মতো ট্রান্সজেন্ডার/রূপান্তরিত লিঙ্গের সঙ্গে সামাজিক ও শরিয়া আচরণ তার মূল লিঙ্গ (যা রূপান্তরের আগে ছিল সে) অনুযায়ী হবে।
বিয়ে, পর্দা, ওয়ারিশ ও মালিকানা এবং সাক্ষ্য প্রদান, ঈমান, ইসলাম, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতসহ সব ইসলামি বিধিবিধান তার মূল লিঙ্গ (যা রূপান্তরের আগে ছিল সে) অনুযায়ী হবে। অনুরূপভাবে হালাল-হারাম, ন্যায়-অন্যায়, হুদুদ ও কিসাস এবং জান্নাত-জাহান্নামও তাদের জন্য সে হিসেবেই সাব্যস্ত হবে। অতএব, কোনো ট্রান্সজেন্ডার/রূপান্তরিত লিঙ্গের সঙ্গে বিপরীত লিঙ্গের বিয়ে শুদ্ধ হবে না। বরং এটি হবে সমকামিতা, যা ইসলামে হারাম ও ঘৃণিত কাজ।
শেষকথা, জেন্ডার ট্রান্সফরমেশন বা লিঙ্গ রূপান্তর আল্লাহর সৃষ্টিতে হস্তক্ষেপ ও বিকৃতি এবং শয়তানের পথ অনুসরণ। এতে না আছে পার্থিব সুখ-শান্তি না পরকালীন মুক্তি। লিঙ্গ রূপান্তরের পর অনেকের আক্ষেপ, পরিতাপ ও আত্মহত্যা এটিই প্রমাণ করে। যদিও এর ওপর মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বিপরীত লিঙ্গের স্বাদ গ্রহণের মতো মুখরোচক মলাট এঁটে দেওয়া হয়েছে।