ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

জুলুমের ইহকালীন পরকালীন শাস্তি

জুলুমের ইহকালীন পরকালীন শাস্তি

আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সব মানুষকে বিভিন্ন শ্রেণিবিন্যাসে সৃজন করেছেন। কাউকে করেছেন ধনবান-শক্তিশালী, আবার কাউকে করেছেন দরিদ্র-অসহায়। শক্তি ও ক্ষমতার প্রশ্নে সবার অবস্থান সমান নয়। দুনিয়ার পরিচালনা পদ্ধতি সঠিকভাবে অবিরত রাখতে এভাবে স্তর নির্ধারণ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীন, নির্বিশেষে সবার প্রতি ইনসাফ ও সম্প্রীতি রক্ষার আদেশ করেছেন। জুলুমসহ সব ধরনের অনাচার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ক্ষমতাবান কর্তৃক অসহায়দের ওপর অযাচিত জুলুমের চিত্র অহরহ ঘটতে দেখা যায়। উঁচু শ্রেণি কর্তৃক সহায়হীন শ্রেণির ওপর দমন-পীড়ন যেন প্রতিষ্ঠিত কোনো নীতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় সর্বপ্রকার জুলুমকে নিষিদ্ধ করেছেন। নবী করিম (সা.) হাদিস শরিফের অসংখ্য স্থানে জালিমের ইহকালীন ও পরকালীন নানাবিধ শাস্তির কথা ব্যক্ত করেছেন।

জুলুমের ব্যাপারে কোরআন-হাদিসের সতর্কবাণী

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অভিযোগ তো তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের ওপর জুলুম করে ও পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। এরূপ লোকদের জন্য আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি।’ (সুরা শূরা : ৪২)।

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘তুমি যদি সেই সময় দেখ (তবে বড় ভয়াল দৃশ্য দেখতে পাবে) যখন জালেমরা মৃত্যু যন্ত্রণায় আক্রান্ত হবে এবং ফেরেশতারা তাদের হাত বাড়িয়ে (বলতে থাকবে) নিজেদের প্রাণ বের কর, আজ তোমাদের লাঞ্ছনাকর শাস্তি দেওয়া হবে।’ (সুরা আনআম : ৯৩)।

নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, হে আমার বান্দা! আমি নিজের জন্য জুলুম হারাম ঘোষণা করেছি এবং তোমাদের পরস্পরের মাঝেও। ফলে তোমরা জুলুম কর না।’ (মুসলিম : ২৫৭৭)।

অন্য হাদিসে আছে, ‘জুলুম তিন প্রকার। ১. যেটা আল্লাহ তায়ালা কখনও ক্ষমা করেন না। যেমন : শিরক। ২. যেটা আল্লাহ তায়ালা চাইলে ক্ষমা করতে পারেন। যেমন : আল্লাহর কোনো হক লঙ্ঘন। ৩. যেটার ক্ষমা বান্দার ক্ষমার ওপর নির্ভরশীল। যেমন : মানুষ পরস্পর একে অন্যের ওপর জুলুম করেছে। মজলুম ক্ষমা না করা পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করবেন না।’ (মুসনাদে বাজ্জার : ৩৪৩৯)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমরা জুলুম করা থেকে বেঁচে থাক। কারণ, জুলুম কেয়ামতের দিন অন্ধকারে পরিণত হবে।’ (মুসলিম : ৬৭৪১)।

দুনিয়াতে জালিমের শাস্তি

স্বাভাবিকভাবে আল্লাহ তায়ালা জালিমদের তাদের জুলুম-অন্যায় এবং সমাজে জুলুমের খারাপ প্রতিক্রিয়ার কারণে দ্রুত শাস্তি দেওয়ার ওয়াদা করেছেন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ও জুলুম করার শাস্তি সবচেয়ে দ্রুত পতিত হয়।’ (বায়হাকি : ২০৩৬৪)।

অন্য হাদিসে আছে, ‘আল্লাহ তায়ালা জালিমকে অবকাশ দেন (এরপর জালিম জুলুম থেকে ফিরে না এলে) তাকে এমনভাবে শাস্তি দেন যে, জালিম সে শাস্তি থেকে পলায়ন করতে পারে না।’ (বোখারি : ৪৬৮৬)। এ কথা বলে নবী (সা.) কোরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন, ‘যেসব জনপদ জুলুমে লিপ্ত হয়, তোমার প্রতিপালক যখন তাদের ধরেন, তখন তার ধরা এমনই হয়ে থাকে। বাস্তবিকই তার ধরা অতি মর্মন্তুদ, অতি কঠিন।’ (সুরা হুদ : ১০২)।

আল্লাহ তায়ালা জালিমকে দুনিয়াতেই লাঞ্ছিত করেন। জীবনের তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করান। দুনিয়াতে জালিমের জীবন থেকে কল্যাণ ও নেয়ামত ছিনিয়ে নেন। বর্ণিত হয়েছে, ‘অতঃপর ঘটল এই যে, তারা যখন নিদ্রিত ছিল, তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সেই বাগানে হানা দিল এক উপদ্রব, ফলে বাগানটি ভোরবেলা হয়ে গেল কাঁটা ক্ষেতের মতো। তারা বলল, নিশ্চয়ই আমরা জালিম ছিলাম।’ (সুরা কলম : ১৯-২৯)।

ইহকালীন জীবনে জালিমদের শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তায়ালা জুলুমের কিসাস বিধান রেখেছেন। বলেছেন, ‘আমি তাদের জন্য বিধান রেখেছিলাম, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান ও দাঁতের বদলে দাঁত। আর জখমেও (অনুরূপ) বদলা নেওয়া হবে। যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধানুসারে বিচার করে না, তারা জালিম।’ (সুরা মায়িদা : ৪৫)।

জালিমদের আল্লাহ তায়ালা সঠিক পথের হেদায়েত দান করেন না। বরং দুনিয়ার জীবনে গোমরাহ করে রাখেন। বলা হয়েছে, ‘যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের এ সুদৃঢ় কথার ওপর স্থিতি দান করেন, দুনিয়ার জীবনেও এবং আখেরাতেও। আর আল্লাহ জালিমদের কারণে বিভ্রান্ত।’ (সুরা ইবরাহিম : ২৭)।

তবে প্রজ্ঞাগত নীতির কারণে আল্লাহ তায়ালা কখনও কখনও জালিমদের অবকাশ দেন। তৎক্ষণাৎ শাস্তি দেন না। এই অবকাশ দানের একটি রহস্য হলো, ধীরে ধীরে জালিমকে কঠিনভাবে শাস্তি দেওয়ার জন্য ছাড় দেওয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আমি তাদের অবকাশ দিই শুধু এ কারণে, যাতে তারা পাপাচারে আরও অগ্রগামী হয় এবং (পরিশেষে) তাদের জন্য আছে এমন শাস্তি, যা তাদের লাঞ্ছিত করে ছাড়বে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৭৮)।

আজাবের উদাহরণ

মিশর সম্রাট বিখ্যাত কাফের ফেরাউন পৃথিবীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। হজরত মুসা (আ.) এর জামানায় মুসলমানদের ওপর চালিয়েছিল বর্বরোচিত জুলুম-অত্যাচার। তার ওপর নিপতিত ধ্বংসশীল আজাবের কথা বর্ণিত হয়েছে, ‘সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদের ধৃত করে সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখ জালিমদের পরিণতি কী হয়েছে।’ (সুরা কাসাস : ৪০)।

আরেক বিখ্যাত জুলুমবাজ কাফের সম্প্রদায় হলো সামুদ গোত্র। তারা হজরত সালেহ (আ.) এর দাওয়াত অমান্য করে ঈমান গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। জুলুমের বিস্তার ঘটিয়েছিল। তাদের শাস্তি হয়েছিল এভাবে, ‘আর যারা জুলুমের পথ অবলম্বন করেছিল, তাদের আঘাত হানল মহাগর্জন। ফলে তারা তাদের ঘরবাড়িতে এভাবে অধঃমুখে পড়ে থাকল।’ (সুরা হুদ : ৬৭)।

জালিমের জন্য বদদোয়া

জুলুমের শিকার ব্যক্তির দোয়া কখনও বিফলে যায় না। মজলুম কাফেরের দোয়াও আল্লাহ কবুল করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মজলুমের বদদোয়াকে ভয় কর। যদিও সে কাফের হয়। কারণ, মজলুমের দোয়া ও আল্লাহর মাঝে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।’ (আহমাদ)।

দোয়ার ফলে আল্লাহ তায়ালা জালিমের বিপক্ষে মজলুমের হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। আসমানে মজলুমের দোয়ার অনেক দাম। নবী (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমার ইজ্জতের কসম, দেরিতে হলেও আমি মজলুমকে অবশ্যই সাহায্য করব।’ (ইবনে হিব্বান : ৮৭৪)। মজলুমের দোয়ার ভেতর মুখাপেক্ষী ভগ্ন হৃদয়, লাঞ্ছিত অন্তরের অনুনয় থাকে। ফলে আল্লাহ তায়ালা একান্ত সাহায্যকারী হয়ে তার দোয়া কবুল করে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে জুলুম থেকে হেফাজত করুন। আমিন!

লেখক : খতিব, আল-মক্কা জামে মসজিদ

হরপাড়া, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত