ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মার্কিন রণতরীতে হুথিদের হামলা, ডুবল যুদ্ধবিমান

* যুদ্ধবিরতি আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি * আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শুনানি * ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত প্রধানের পদত্যাগ * গাজায় নিহত আরও ৭১
মার্কিন রণতরীতে হুথিদের হামলা, ডুবল যুদ্ধবিমান

লোহিত সাগরে অবস্থান করা মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস হ্যারি ট্রুম্যান এবং এর সঙ্গে থাকা যুদ্ধজাহাজগুলোতে হামলা চালিয়েছে ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহর নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী। বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি সোমবার এই তথ্য জানিয়ে বলেছেন, নৌবাহিনী, ড্রোনবাহিনী ও মিসাইল ইউনিট যৌথভাবে এই হামলা চালায়। হামলায় ক্রুজ মিসাইল ও অ্যাটাক ড্রোন ব্যবহার করা হয়। সারি জানান, এরপর নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয় এই মার্কিন রণতরী। মার্কিন রণতরী ও যুদ্ধজাহাজগুলোতে আঘাত হানার পাশাপাশি ইসরায়েলের আসকালানে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ড্রোন হামলা চালান তারা। এতে ‘ইয়াফা’ শ্রেণির ড্রোন ব্যবহার করা হয়। হামলার লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বলে জানান হুথি মুখপাত্র।

হামলা এড়াতে গিয়ে ডুবল মার্কিন যুদ্ধবিমান : মার্কিন বিমানবাহী রণতরীতে সমন্বিত হামলা চালানোর সময় রণতরী থেকে একটি এফএ-এইটিন সুপার হর্নেট যুদ্ধবিমান সাগরে পড়ে ডুবে গেছে। যুদ্ধবিমানটির দাম ছয় কোটি ডলারের বেশি। একজন মার্কিন কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহর যোদ্ধাদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত এড়াতে রণতরীটি বড় ধরনের একটি বাঁক নিয়েছিল। তখন যুদ্ধবিমানটি সাগরে পড়ে যায়। এ ঘটনায় একজন নাবিক আহত হয়েছেন জানিয়ে নৌবাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়, রণতরীর যুদ্ধবিমান রাখার স্থানে এফএ-এইটিন বিমানটি টেনে নেওয়া হচ্ছিল। এ সময় ক্রু যুদ্ধবিমানটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। এতে যুদ্ধবিমান ও সেটিকে টেনে নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত ট্রাক্টর দুটিই সাগরে পড়ে যায়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যুদ্ধবিমানটি সরিয়ে নেওয়ার কাজে নিয়োজিত ক্রুরা বিমানটি সাগরে পড়ে যাওয়ার আগে বেরিয়ে আসতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেন।

আরেকজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, যুদ্ধবিমান এবং ট্রাক্টর- দুটিই ডুবে গেছে। এর আগে গত ডিসেম্বরে ইউএসএস ট্রুম্যানের আরেকটি এফএ-এইটিন যুদ্ধবিমানকে ‘ভুলবশত’ ভূপাতিত করে লোহিত সাগরে থাকা মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস গেটিসবার্গ। ওই ঘটনায় দুই পাইটল নিরাপদে যুদ্ধবিমান থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। এদিকে, হুথি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে চলমান সামরিক অভিযানে মধ্য মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সাতটি এমকিউ-নাইন র‌্যাপার ড্রোন হারিয়েছে বলে গত সোমবার এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘১৫ মার্চ থেকে সাতটি এমকিউ-নাইন খোয়া গেছে।’ তবে এসব ড্রোন হারানোর সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ করেননি তিনি। এ ধরনের প্রতিটি ড্রোনের দাম তিন কোটি ডলারের বেশি বলে জানিয়েছে এএফপি। এর আগে হুথিরা জানিয়েছেন, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আগ্রাসনের জবাবে তারা এসব মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করেন। বিশ্লেষকদের মতে, হুথি যোদ্ধাদের মনুষ্যবিহীন ড্রোন চিহ্নিত করার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, এসব ঘটনা তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত।

যুদ্ধবিরতি আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি : গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে কায়রোর আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছে দুটি মিসরীয় সূত্র। তারা জানান, সম্পৃক্ত পক্ষগুলো গাজা উপত্যকায় দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি নিয়ে ঐকমত্যসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হয়েছে। তবে তারা জানিয়েছেন, অগ্রগতির পরও হামাসকে নিরস্ত্রীকরণের মতো কিছু জটিল বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে। কায়রোর এই আলোচনা শেষ হয় ২৬ এপ্রিল। হামাসের শুরা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ দারবিশের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল মিসরীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা নিবিড় আলোচনার পর এদিন কায়রো ত্যাগ করেন। আলোচনায় গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা, বন্দিবিনিময় সহজতর করা এবং উপত্যকায় অবাধ মানবিক সহায়তা প্রবেশের বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। কায়রো ত্যাগের পর হামাস নেতারা সিরিজ বৈঠকে অগ্রগতি এসেছে বলে জানালেও সাফ বলেছিলেন, হামাস কখনও অস্ত্র ছাড়বে না। ইসরায়েলি দখলদারিত্ব থেকে ফিলিস্তিনকে রক্ষা করতে তারা সশস্ত্র আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শুনানি : অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণ ঢুকতে দেওয়ার মানবিক বাধ্যবাধকতা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত আইসিজে-তে শুনানি শুরু হয়েছে। গত সোমবার নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে জাতিসংঘের এই প্রধান আদালতের মূল ভবন পিস প্যালেসে শুনানি শুরু হয়। এই মৌখিক শুনানি চলবে পাঁচ দিন। যদিও ইসরায়েল ওরাল প্রসিডিংসে অংশ নিচ্ছে না। তবে, তারা লিখিত পরামর্শ ও আপত্তি জমা দিয়েছে। আইসিজের শুনানির শুরুতে কথা বলেন সুইডেনের আইনজীবী ও কূটনীতিক এলিনর হামারশোল্ড। ২০২৫ সাল থেকে তিনি জাতিসংঘের আইনবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং প্রধান আইন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় কোনো দেশ বলপ্রয়োগ করে অন্য দেশের ভূখণ্ড অধিগ্রহণ করতে পারে না। এটা নিষিদ্ধ।’ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে হামারশোল্ড বলেন, ‘ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলগুলোর ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব দাবি করার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু ইসরায়েলের পার্লামেন্ট জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা আনরোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। এর মাধ্যমে দেশটি আসলে ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভূখণ্ডের ওপর সার্বভৌমত্ব বিস্তারের চেষ্টা করেছে।’ হামারশোল্ডের যুক্তি, ‘ইসরায়েলের পার্লামেন্টে গৃহীত এসব আইন এবং অধিকৃত অঞ্চলে প্রয়োগযোগ্য দেশটির অন্যান্য আইনের ভিত্তিতে নেওয়া পদক্ষেপগুলো আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’ হামারশোল্ড জোর দিয়ে বলেন, ‘ফিলিস্তিনি জনগণ এবং জাতিসংঘ কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইসরায়েলের দায়িত্ব।’ ২০২৪ সালের অক্টোবরে আনরোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে ইসরায়েলি পার্লামেন্ট। ইসরায়েল জাতিসংঘের সদস্য হওয়ায় বিলটির মধ্য দিয়ে বিশ্ব সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাকালীন সনদ লঙ্ঘিত হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত প্রধানের পদত্যাগ : ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান রোনেন বার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তাকে পদ থেকে সরাতে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ব্যর্থ প্রচেষ্টার ছয় সপ্তাহ পর পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন বার। ১৫ জুন থেকে এই ঘোষণা কার্যকর হবে। সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত। সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তা রোনেন বারের সঙ্গে নেতানিয়াহুর ডানপন্থি জোট সদস্যদের দীর্ঘদিন থেকেই টানাপড়েন চলছিল। গত সোমবার এক বিবৃতিতে রোনেন বলেন, ‘আমি আমার ৩৫ বছরের চাকরি জীবনের ইতি টানছি। আগামী ১৫ জুন আমি পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই সময়সীমার মধ্যে একজন যোগ্য ও পেশাদার উত্তরসূরীকে বেছে নেওয়া হবে এবং তার হাতে দায়িত্ব অর্পণ করা হবে।’ এর আগে ১৬ মার্চ, নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে বারের প্রতি তার আস্থার অভাবের কথা জানান। তাকে নিয়ে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিষেবার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আস্থার সমস্যা রয়েছে বলে অভিযোগ করেন। অন্যদিকে বার বলেন, ‘নেতানিয়াহু নিজের বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভ দমন করার এবং নিজের দুর্নীতির বিচারকে প্রভাবিত করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।’ পাল্টাপাল্টি অভিযোগের জেরে শেষ পর্যন্ত সরে গেলেন রোনেন বার।

গাজায় নিহত আরও ৭১ : গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত সোমবার জানিয়েছে, অবরুদ্ধ উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর টানা হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত আরও ৭১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। এ নিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ৫২ হাজার ৩১৪ জনে পৌঁছেছে। গাজার মিডিয়া অফিসের আপডেট তথ্য বলছে, নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০-রও বেশি হবে। কারণ, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া হাজার হাজার মানুষ আর বেঁচে নেই বলেই ধারণা করা হচ্ছে। মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি। এ সময় ইসরায়েল ১৮ হাজারের বেশি শিশু এবং ১২ হাজার ৪০০ ফিলিস্তিনি নারীকে হত্যা করেছে। হামলায় কেউ বেঁচে নেই এমন পরিবারের সংখ্যা দুই হাজার ১৮০। মাত্র একজন বেঁচে আছেন এমন পরিবারের সংখ্যা ৫০ হাজার ৭০। ইসরায়েলি বর্বরতায় নিহত হয়েছেন এক হাজার ৪০০ জন চিকিৎসাকর্মী, ২১২ জন সাংবাদিক ও ৭৫০ জন সহায়তাকর্মী।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত