ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ঈদে সড়ক রেল নৌপথে স্বস্তি

* স্পেশাল ট্রেন-বাস-লঞ্চ সার্ভিস চালু * কঠোর নজরদারিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
ঈদে সড়ক রেল নৌপথে স্বস্তি

ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। সেই আনন্দ ভাগাভাগি করতে শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটছেন মানুষ। ঈদযাত্রার বাড়তি চাপ সামাল দিতে বিশেষ ট্রেন, বাস ও লঞ্চ চালু করা হয়েছে। ফলে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষের কাছে এবারের ঈদুল আজহা বেশ স্বস্তির। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের ঈদযাত্রার স্বস্তির পেছনে যে কয়টি কারণ রয়েছে- এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য সাস্প্রতিক সময়ে সড়কে কিছুটা সক্ষমতা বেড়েছে। সড়ক চার লেনে উন্নতিকরণ, ওভারপাস নির্মাণ, নির্ধারিত সময়ে ট্রেন ও বাস ছাড়া, এবার লম্বা ছুটি, মহাসড়ক ও টার্মিনালগুলোয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো এবং মোড়ে মোড়ে চাঁদারোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে ১০টি স্পেশাল ট্রেন চালু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গতকাল কমলাপুর স্টেশন থেকে স্পেশাল ট্রেনগুলো বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ঈদের আগে-পরে ৯ দিন চলবে স্পেশাল ট্রেনগুলো। এ ছাড়াও যাত্রীদের ভোগান্তি দূর করতে আগেভাগেই মহাসড়ক মেরামত করেছে সড়ক বিভাগ। উত্তরাঞ্চলে চার লেন সড়ক (আংশিক) উন্নতি ও ওভারপাস করায় যানজট কমেছে। ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ সড়কের পাশাপাশি লঞ্চে যাতায়াত করছে। পদ্মা সেতুর প্রভাবে এতোদিন লঞ্চে যাত্রীসংকটে পড়লেও শেষ সময়ে ঈদযাত্রায় লঞ্চেই স্বস্তি খুঁজে নিয়েছে যাত্রীরা। ঢাকা-বরিশাল নৌপথে স্পেশাল লঞ্চ সার্ভিস চালু হয়েছে। রোটেশন প্রথা ভেঙে এবার এই রুটে ১০ থেকে ১২টি লঞ্চ চলাচল করছে। বাসযাত্রীরা স্বস্তিতে : রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে তেমন ভিড় না থাকলেও মানুষের চাপ রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে কাউন্টার থেকে ছাড়ছে পরিবহন। এছাড়া গত মঙ্গলবার থেকে ‘ঈদ স্পেশাল সার্ভিস’ চালু করেছে সরকারের পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি)। বিশেষ সেবার জন্য ৬৫০ বাস চালু করা হয়েছে, এসব বাস চলবে ১৪ জুন পর্যন্ত। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, ডাকাতি ও ছিনতাইসহ নারী যাত্রীদের হেনস্তা রোধে দূরপাল্লার প্রতিটি বাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে মালিক সমিতির পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। আশা করি, এবারও মানুষ স্বস্তিতে ঘরে ফিরতে পারবেন। উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়কে যানবাহনের চাপ থাকলেও যাত্রীরা স্বস্তিতে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন। সাধারণত ঈদের সময় এসব মহাসড়কে যেভাবে যানজট লেগে থাকে, এবার সেই চিত্র নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকার কারণে অনেকটাই শৃঙ্খলিত রয়েছে পুরো যাত্রাপথ। হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রউফ জানান, জেলা পুলিশের সমন্বয়ে তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছেন। মহাসড়কে কোনো যানজট নেই। গাজীপুরের ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ বাড়লেও কাথাও যানজট সৃষ্টি হয়নি। স্বাভাবিকভাবে যানবাহন চলাচল করছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ঘুরে চালক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১০ দিনের ছুটিতে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটছেন। রাজধানী ও গাজীপুর থেকে বের হওয়ার পথ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তায় যাত্রীদের ভিড় দেখা গিয়েছে।

ময়মনসিংহগামী তাসকিন পরিবহনের চালক লিয়াকত মিয়া বলেন, গতকাল সকালে ময়মনসিংহ থেকে চান্দনা চৌরাস্তায় যাত্রী নামিয়ে ফের ময়মনসিংহের যাত্রী তুলছিলেন। সকালে যাত্রীর পরিমাণ কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীর সংখ্যা বাড়ায় গাড়িতে যাত্রী তুলতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। তবে, ময়মনসিংহ থেকে আসার সময় মহাসড়কের তেমন কোনো যানজট দেখেননি তিনি। আরেক বাস চালক সবুজ সরকার বলেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মোড়ে মোড়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলার কারণে যানবাহন চলাচলে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে। দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মহাসড়কের পাশে দাঁড়ানো বাসগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে যানজট সম্ভাবনা একদমই থাকবে। সালনা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শওকাতুল আলম বলেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে হাইওয়ে পুলিশ কাজ করছে। মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক আছে। গাজীপুর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মাহবুবুর রহমান বলেন, ঈদযাত্রায় চন্দ্রায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও জেলা পুলিশ কাজ করছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) এসএম আশরাফুল আলম বলেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে পুলিশের পক্ষ থেকে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম ও সিলেট পথে ভোগান্তি নেই : গতকাল বুধবার ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যাত্রীরা বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়েননি। ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হওয়ায় যাত্রীরা খুশি। ঢাকা সাইনবোর্ড থেকে ফেনীর উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন গৃহবধূ রাজিয়া সুলতানা। অন্যান্য বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ভোগান্তির শঙ্কা নিয়ে গতকাল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে সাইনবোর্ডে এসেছিলেন; কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে কোনোরকম ভোগান্তিতে না পড়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন রাজিয়া। তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের নিয়ে এত সহজে বাসে উঠতে পারব ভাবি নাই। খুব ভালো লাগছে।’

লঞ্চঘাটে ভিড় নেই: মহাসড়কের পাশাপাশি ঢাকা-বরিশাল নদীপথে যাত্রী বাড়ছে। যাত্রীর বাড়তি চাপ সামলাতে বিশেষ লঞ্চ সার্ভিস চালু রাখা হয়েছে। লঞ্চমালিকরা বলেন, ঈদুল আজহায় বিশেষ সার্ভিসের গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকার সদরঘাট থেকে শুরু হয়েছে। এই বিশেষ সার্ভিস চলবে ১৪ জুন পর্যন্ত। এই সার্ভিসে যুক্ত হয়েছে অন্তত ১৬টি লঞ্চ। অভ্যন্তরীণ লঞ্চ মালিক সমিতির মহাসচিব সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ঈদের সময় আগের রোটেশন প্রথা তুলে দিয়ে যাত্রী চাহিদা অনুযায়ী লঞ্চের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। লঞ্চের বিশেষ সার্ভিস চালু রাখা হয়েছে। বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী পরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, ঈদুল আজহায় যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত করা হয়েছে। ঝড়ের মৌসুম হওয়ায় বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নৌ নিরাপত্তায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের ব্যাপারে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা রয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চে সেই আগের চিরচেনা ভিড় নেই। যাত্রীস্বল্পতার কারণে এই পথে লঞ্চের সংখ্যা কমে গেছে। তবে ঈদের সময় কিছুটা ভিড় বাড়ে। গতকাল সদরঘাটে যাত্রীদের ভিড় দেখা গেছে।

নির্ধারিত সময়ে ছাড়ছে ট্রেন : বাস ও লঞ্চের পাশাপাশি ট্রেন যাত্রীদের ভিড় বেড়েছে। কমলাপুর স্টেশন থেকে নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে যাচ্ছে ট্রেন। আগাম টিকিট কাটা বলে এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোর যাত্রীরা নিজ নিজ আসনে বসে যাচ্ছেন গন্তব্যে। যাত্রীদের বাড়তি চাপ সামালাতে স্পেশাল ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়েছে। গতকাল ঈদুল আজহার ১০ দিনের ছুটি শুরু হওয়ায় ট্রেনে ঈদযাত্রীদের বেশি ভিড় দেখা গেছে। ঈদযাত্রার বিড়ম্বনা আর শিডিউল বিপর্যয় না থাকায় স্বস্তির ছাপ যাত্রীদের চোখে-মুখে; স্বাভাবিক সময়ের মতই ১৫-২০ মিনিট পরই প্লাটফর্ম ছাড়ছে ট্রেন। ভিড় বাড়লেও স্বস্তির ঈদযাত্রা কমলাপুর ও এয়ারপোর্ট স্টেশনে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, স্টেশনে প্রবেশের জন্য বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে লাইন তৈরি করা হয়েছে। বিনা টিকিটের যাত্রীরা টিকিট প্রদর্শন না করে প্রথম ধাপ পার হতে পারছেন না। এরপর দ্বিতীয় ধাপে আবারও টিকিট যাচাই করা হচ্ছে। সবশেষ প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের আগে পুনরায় টিকিট প্রদর্শন করে যাত্রীদের প্রবেশ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া চুরি-ছিনতাইসহ যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর রয়েছে। স্টেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ ঈদযাত্রায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।

এবার সময়মতো স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা, বিনা টিকিটের যাত্রী প্রতিরোধসহ নানান উদ্যোগের ফলে এবার ঈদযাত্রা স্বস্তির হচ্ছে। দেওয়ানগঞ্জের যাত্রী উম্মে আফসানা বলেন, তিস্তা ঈদ স্পেশাল ট্রেনের টিকিট কেটেছি। অনেকদিন পরে বাড়ি যাচ্ছি। পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটাব, এটাই অনেক আনন্দের। রাজশাহীর উদ্দেশে কমলাপুর স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা শিউলি আক্তার বলেন, এবার স্টেশনের ব্যবস্থাপনা ভালো। টিকিট ছাড়া যাত্রীরা স্টেশনে ঢুকতে পারছে না, এটা ভালো উদ্যোগ। ট্রেনও সময়মতো ছাড়ছে। এ বিষয়ে ঢাকা রেলস্টেশন ম্যানেজার মো. সাজেদুল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। তিন স্তরের টিকিট চেকিং ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর আছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত