মার্কিন সমর্থিত গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির নিশ্চয়তা চায় হামাস। গত বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীটির ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি এ কথা বলেন। ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে। ওই ব্যক্তি বলেছেন, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গ্রহণ করলে গাজায় হানাহানির অবসান হবে- এই নিশ্চয়তা চাইছে হামাস। বিপরীতে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, চুক্তির বিস্তারিত নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে হামাস জানিয়েছে, ফিলিস্তিনের অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা চলছে। সবার সঙ্গে মতবিনিময় শেষে মধ্যস্থতাকারীদের কাছে তাদের সিদ্ধান্ত জানানো হবে। এবারের প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর ও জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিতের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে অনুপ্রবেশ করে হামলা চালায় হামাস। ওইদিন অন্তত ১২০০ জন ইসরায়েলি নিহত এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয় বলে দাবি করে আসছে নেতানিয়াহু সরকার। এই হামলার জবাবে শুরু হওয়া ইসরায়েলি আগ্রাসনে অন্তত ৫৭ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের কথিত ১২ দিনের সংঘাতের অবসান ঘটানোর ধারাবাহিকতা গাজায় ধরে রাখতে আগ্রহী ট্রাম্প প্রশাসন। তবে গতকালও গাজায় ইসরায়েলি হামলার তীব্রতা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বয়ান অনুযায়ী, ইসরায়েলি বিমান হামলায় গতকাল অন্তত ৫৯ জন নিহত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, গাজায় হামাসের সঙ্গে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি কার্যকরের প্রাথমিক শর্তে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল। এই সাময়িক বিরতির সময় যুদ্ধ পুরোপুরি অবসান নিশ্চিতে কাজ করবে সংশ্লিষ্ট পক্ষরা।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা জানান, যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদনের প্রস্তুতি তাদের দিকে প্রায় চূড়ান্ত। একাধিক সূত্র বলছে, শুক্রবারের মধ্যে হামাস ইতিবাচক সাড়া দিলে ইসরায়েলি প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেবেন। পুরো বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এক কর্মকর্তা বলেছেন, ১০ জন জিম্মি এবং ১৮ জিম্মির মরদেহের বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগারে আটক ফিলিস্তিনিদের মুক্তির বিষয়টি প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত আছে। হামাসের হাতে এখনও অর্ধশত জিম্মি আছে বলে জানা গেছে, যার মধ্যে জনা বিশেক জীবিত আছেন বলে ধারণা করছে ইসরায়েল।
ওই ব্যক্তির বরাতে জানা যায়, প্রস্তাবে আরও রয়েছে, যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলে তাৎক্ষণিকভাবে গাজায় ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ করতে দেওয়া হবে। একইসঙ্গে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারও শুরু করা হবে। স্থায়ী যুদ্ধাবসানের বিষয়েও এই সময়ের মধ্যে আলোচনা শুরুর পরিকল্পনা রাখা হয়েছে প্রস্তাবে। উল্লেখ্য, ইসরায়েল ও হামাসের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে একাধিকবার যুদ্ধবিরতির আলোচনা ভেস্তে গেছে। হামাসের পুরো নির্মূল এবং তাদের অস্ত্রত্যাগ নিশ্চিত না হলে যুদ্ধ থামাতে চায় না ইসরায়েল। আর ইসরায়েলি সেনা গাজা থেকে পুরো প্রত্যাহার ছাড়া আলোচনা হবে না বলে গোঁ ধরে আছে হামাস।
গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে ৬ শতাধিক নিহত: জাতিসংঘ অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় শুক্রবার (৪ জুলাই) সকালে ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ১৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আরও ২০ জন মারা গেছেন সহায়তার জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় গুলিতে। এক হাসপাতালের মর্গ থেকে এসব লাশ গ্রহণ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর শুক্রবার জানিয়েছে, গাজায় মানবিক সহায়তা কনভয় ও বিতরণকেন্দ্রের কাছে অন্তত ৬১৩ জন নিহত হয়েছেন। এসব বিতরণকেন্দ্র পরিচালনা করছিল একটি যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সমর্থিত সংস্থা জিএইচএফ। সংস্থাটি মে মাসের শেষ দিক থেকে কার্যক্রম শুরু করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বলেন, এখনই নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না, কারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। তবে তিনি আরও বলেন, এটা স্পষ্ট যে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সাহায্য বিতরণকেন্দ্রে পৌঁছাতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর গোলাবর্ষণ ও গুলিবর্ষণ করেছে।
নাসের হাসপাতাল নিশ্চিত করেছে, শুক্রবারের বিমান হামলায় নিহতদের মধ্যে আটজন নারী ও একজন শিশু রয়েছে। যারা গুলিতে মারা গেছেন, তাদের মধ্যে দুজন রাফাহর কাছে সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রে প্রাণ হারিয়েছেন। বাকি ১৮ জন মারা গেছেন গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ট্রাকের কাছে সাহায্য নিতে গিয়ে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সর্বশেষ এই হামলার বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। এদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী নিশ্চিত করেছে, উত্তর গাজায় তাদের একজন সেনা নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে তদন্ত চলছে। পুরো যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ৮৬০ জনের বেশি সেনা নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৪০০-এর বেশি মারা গেছেন গাজায় স্থলযুদ্ধে।
এই সহিংসতার মধ্যেই যুদ্ধ বন্ধে নতুন কূটনৈতিক উদ্যোগ চলছে। হামাস জানিয়েছে, মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতায় উপস্থাপিত একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে তারা অন্যান্য ফিলিস্তিনি দলের সঙ্গে আলোচনা করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মঙ্গলবার বলেছেন, ইসরায়েল ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তিনি হামাসকে দ্রুত প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে বলেছেন, নাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে নিহত শত শত মানুষ : এক সপ্তাহের সামান্য কয়েকদিন আগের ঘটনা। মাহমুদ কাসিম তার ছেলে কাদেরকে হারিয়েছেন। ১৯ বছর বয়সী কাদের মধ্য গাজায় মার্কিন সমর্থনে চলা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন।
কাসিম বলেছেন, “ওইদিন রাত ১১টা নাগাদ আমি এবং ওর মা শেষবারের মতো ফোনে কাদেরের সঙ্গে কথা বলি। ও আমাদের জানায়, নেটজারিম ত্রাণকেন্দ্রে নিরাপদ জায়গায় আছে। আমি ওকে সাবধানে থাকতে বলি। ১টা নাগাদ আমি ওকে ফোন করি। কিন্তু ফোনে সাড়া পাইনি। দুইটা পর্যন্ত অপেক্ষা করি।” তারপর কাসিম মধ্য গাজায় যান। হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নেন। শেষপর্যন্ত কাদেরের মরদেহ খুঁজে পান। দেখা যায়, অনেকগুলো বুলেটের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। কাসিম বলেছেন, “একজন ১৯ বছর বয়সী তো সবে তার জীবন শুরু করেছে। সে খাবারের বাক্স আনতে গিয়েছিল। আমি চাইনি। কিন্তু ছেলে মনে করলো, পরিবারকে সাহায্য করা উচিত। ওখানে অবর্ণনীয় অবস্থা। মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে। না হামাস, না ইসরায়েল, না আরব দেশগুলো, কেউ আমাদের জন্য ভাবে না।” গাজায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছেন। বাস্তবতা হলো, গাজার ২৩ লাখ মানুষ পুরোপুরি ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল। আর ত্রাণ আসে ইসরায়েল হয়ে। গাজার প্রায় সকলেই ঘরছাড়া হয়েছিলেন। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজার ৫৭ হাজার মানুষ মারা গেছেন। গত মে মাসের সমীক্ষা অনুসারে ৯৩ শতাংশ মানুষ খাদ্যসংকটে ভুগছেন। জাতিসংঘ ত্রাণ দেওয়া শুরু করেছে, আমেরিকাণ্ডইসরায়েলের সংস্থা জিএইচএফ তিনটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র খুলেছে। তা সত্ত্বেও গাজার মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম খাবার পাচ্ছেন। ক্রাণভর্তি ট্রাক সশস্ত্র গোষ্ঠী বা বেসামরিক মানুষ লুট করে নিচ্ছে, এমন ঘটনাও ঘটছে। এর মধ্যে ইসরায়েলের সেনা উত্তর ও দক্ষিণ গাজায় বিমান হামলা চালাচ্ছে। তারা সেখান থেকে মানুষকে সরে যেতে বলেছে। আবু লিবদার বয়স ৪৪ বছর। পাঁচ সন্তানের বাবা। খান ইউনিস দিয়ে যখন একটা ত্রাণবোঝাই ট্রাক যাচ্ছিল, তিনি একটা ময়দার বস্তা নিতে পেরেছিলেন। তিনি ফোনে বলেছেন, “আমি জানি এটা ঝুঁকির কাজ। কিন্তু আমাদেরও তো কিছু খেতে হবে। হাজার হাজার মানুষ ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম দুটো গোলা ফাটার শব্দ। আমি দেখলাম অনেক মানুষ রাস্তায় পড়ে গেলেন। অনেকের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। সৌভাগ্যবশত, আমার আঘাত লেগেছে হালকা।” গাজায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েলের সেনার গুলি ও গোলার আঘাতে পাঁচশর বেশি মানুষ মারা গেছেন। তারা ত্রাণের অপেক্ষায় ছিলেন। হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইসরায়েলসহ বেশ কিছু দেশ। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই দাবি অগ্রাহ্য করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে জানিয়েছে, “হামাস বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে। গাজার মানুষের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, হামাস ইসরায়েলের সেনার ওপর মিথ্যা অভিযোগ করছে। তারা মৃতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলছে, ভুয়া ভিডিও ছড়াচ্ছে।” গত মঙ্গলবার অক্সফাম, সেভ দ্য চিল্ডরেনসহ ১৩০টি বড় সেবা প্রতিষ্ঠান ও এনজিও জিএইচএফকে বলেছে, তারা যেন ত্রাণশিবির বন্ধ করে দেয়। কারণ, ফাউন্ডেশনের ত্রাণশিবির সামরিক এলাকা বা তার কাছে, সেখানে হাজার হাজার মানুষ যাচ্ছেন। তাদের গুলির মুখে পড়তে হচ্ছে। জিএইচএফের চেয়ারম্যান জনি মুর ব্রাসেলসে বুধবার সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, তারা ত্রাণশিবির বন্ধ করবেন না। তারা এখনো পর্যন্ত পাঁচ কোটি ৫৫ লাখ মিল বিতরণ করেছেন। তারা জাতিসংঘ ও অন্য ত্রাণসংস্থার সঙ্গে একযোগে কাজ করতে ইচ্ছুক। তিনি বলেছেন, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রতিদিন মৃত্যুর তালিকা দেয় এবং বলে তারা জিএইচএফের ত্রাণ নিতে গিয়েই মারা গেছেন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) আগে অনেকবার বলেছে, ত্রাণ নিতে গিয়ে সামরিক পজিশনের খুব কাছে যখন মানুষ চলে আসে, তখন তারা সাবধান করে দেওয়ার জন্য গুলি ছোড়ে। তবে এর ফলে কতজন মারা গেছেন সেই সংখ্যা তারা জানায়নি।
গাজায় গণহত্যা চালাতে ‘ক্ষুধা’কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল:
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় গণহত্যা চালানোর জন্য মানুষকে অনাহারে রাখাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল। এমন মন্তব্যই করেছে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
এছাড়া গাজায় শিশুদের জন্য পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল এখনও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ‘ক্ষুধা’কে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, যা ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান গণহত্যার অংশ।
লন্ডনভিত্তিক এই সংগঠনটি বলেছে, গাজার পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। টানা বোমাবর্ষণ, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, খাদ্য, পানি ও ওষুধের সংকট — সব মিলিয়ে মানবিক বিপর্যয় চরমে।
অ্যামনেস্টির সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস কালামার্ড বলেছেন, “ইসরায়েল যে জীবনধারণের মৌলিক চাহিদাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করছে — তা আসলে শারীরিকভাবে ধ্বংস করে ফেলার এক কৌশল”। তার ভাষায়, এই অবস্থা গণহত্যার সংজ্ঞার মধ্যেই পড়ে।
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহায়তা নিতে গিয়ে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত বা আহত হয়েছেন — কখনও ত্রাণ বিতরণ পয়েন্টে, কখনও সাহায্যের খোঁজে যাওয়ার পথেই। তাদের ভাষায়, “ইসরায়েলের পরিচালিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) ত্রাণ ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে একটা ফাঁদে পরিণত হয়েছে। ক্ষুধার্ত মানুষ সেই ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন।” প্রতিদিন শত শত সাহায্যবাহী ট্রাক গাজার বাইরে অপেক্ষা করলেও ইসরায়েলের অনুমতি না মেলায় সেগুলো ঢুকতে পারছে না। এদিকে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের পর এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৬ শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে মারা গেছে বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি। আরও বহু শিশু অসুখে ভুগে মারা গেছে, যেগুলো প্রতিরোধযোগ্য ছিল যদি সেখানে খাবার ও ওষুধ থাকত।
উদাহরণ হিসেবে ৪ মাস বয়সী জিনান ইসকাফি নামে এক শিশুর মৃত্যুর তথ্য তুলে ধরা হয়। ছোট্ট এই শিশুটি দুধের অভাবে অত্যন্ত পানিশূন্যতা ও অপুষ্টিতে মারা যায়। গাজা শহর ও খান ইউনিসের হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন যে শিশুরা স্বাস্থ্য পরীক্ষায় আসছে, তাদের প্রায় ১৫ শতাংশের মধ্যে গুরুতর বা মাঝারি অপুষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, “প্রাথমিক চিকিৎসার পরেও অনেক শিশু আবার অসুস্থ হয়ে ফিরছে, কারণ ক্যাম্পের পরিস্থিতি আরও খারাপ।” এছাড়া চিকিৎসকরাও বিপদে রয়েছেন। নিজেরাই বাস্তুহারা ও অপুষ্টিতে ভোগা অনেক চিকিৎসক তাদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন। অ্যামনেস্টি বলেছে, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শুধু ইসরায়েলের গণহত্যা থামাতেই ব্যর্থ নয়, বরং তারা এই ধ্বংসযজ্ঞ চলতে দিচ্ছে।”
সংস্থাটি জোর দিয়ে বলেছে, ইসরায়েলের জন্য সব ধরনের সামরিক সহায়তা বন্ধ করতে হবে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং যেসব ইসরায়েলি কর্মকর্তা অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। গাজায় হিরোশিমার চেয়ে ৬ গুণ বোমা ফেলেছে ইসরাইল : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় যে পরিমাণ বোমা ফেলা হয়েছিল, তার ছয় গুণ বেশি বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে গাজায়। গত ২১ মাসে নিক্ষেপ করা বোমার পরিমাণ ৮৫ হাজার টন বলে জানিয়েছেন ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রানচেসকা আলবানিজ।
বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি বলেন, এসব কোম্পানির সহায়তায় গত ২১ মাসে গাজায় ৮৫ হাজার টন বোমা নিক্ষেপ করেছে ইসরাইল। এই পরিমাণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমায় ফেলা বোমার চেয়ে ছয় গুণ বেশি। গাজায় আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর গণহত্যার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করেন তিনি।
আলবানিজ ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনকে একটি মৃত্যুফাঁদ হিসেবে নিন্দা জানিয়েছেন। বলেন, ক্ষুধার্ত, বোমাবর্ষণকারী এবং ক্ষীণকায় জনগোষ্ঠীকে হত্যা বা পালিয়ে যেতে বাধ্য করার জন্য এটি তৈরি করা হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি নিয়ে জোর আলোচনার মধ্যেও গাজায় বোমাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে ইসরাইলি বাহিনী। আল জাজিরা বলছে, স্থানীয় সময় শুক্রবার ভোরে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় নির্বিচারে হামলা চালায় ইসরাইলি সেনারা। এতে হতাহত হন বেশ কয়েকজন। এক বিবৃতিতে বিষয়টি নিশ্চিত করে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। হামলা চলে দক্ষিণাঞ্চলের শহর খান ইউনিসেও।
এদিকে, গাজায় গণহত্যা চালানোর জন্য মানুষকে অনাহারে রাখাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরাইল। এমন মন্তব্যই করেছে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটির বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা আনাদোলু জানায়, বোমাবর্ষণ, বাস্তুচ্যুতি, খাদ্য, পানি ও ওষুধের সংকট — সব মিলিয়ে অঞ্চলটিতে মানবিক বিপর্যয় এখন চরমে। সহায়তা নিতে গিয়ে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত বা আহত হয়েছেন। অনেক ক্ষুধার্ত মানুষ ইসরাইল পরিচালিত হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন।