
ভোলার চরফ্যাশনে কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার। ছত্রাক থেকে তৈরি এ জৈব সারে মাটি উর্বর হওয়ায় জমিতে বাম্পার ফলনে কৃষকরা পাচ্ছেন সাফল্য। উপজেলার জিন্নাগড় ইউনিয়নে ৮নং ওয়ার্ডে ছত্রাক থেকে এ সার উৎপাদন করছেন উদ্যোক্তা মো. সোলায়মান। তার থেকে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন অন্যরাও। ট্রাইকো কম্পোস্ট সার সাধারণ কৃষকের কাছে এখন দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। স্বল্প খরচে কৃষকরা তাদের ফসলি জমিতে ফেলছেন। খরচও যেমন কম আবার উপকৃতি হচ্ছেন কৃষকরা। পরিবেশবান্ধব ও বিষমুক্ত। এ সার বিক্রি করে মো. সোলায়মান প্রতিমাসে গড়ে আয় করে ১ লাখ টাকা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানান, ট্রাইকোডার্মা নামক ছত্রাক থেকে ট্রাইকো কম্পোস্ট উৎপাদন করা হয়। এটি এক প্রকার জৈব সার। বিভিন্ন জৈব উপাদানকে ট্রাইকোডার্মার সঙ্গে মিশিয়ে, পচন ঘটিয়ে তৈরি করা হয় এ সার। এ সার মাটির উর্বরতাবাড়ায় এবং উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। গোবর, কচুরিপানা, মুরগির বিষ্ঠা, কাঠের গুঁড়া, ভুট্টার গুঁড়া, কলাগাছ কুচি, সরিষার খোল, নিমপাতা এবং অন্যান্য উদ্ভিদজাত দ্রব্য ব্যাবহার করে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার তৈরি করা হয়।
উপাদানগুলো একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে, তার উপর ট্রাইকোডার্মা নামক ছত্রাক প্রয়োগ করা হয়। এরপর এসব মিশ্রণকে একটি নির্দিষ্ট সময় ৪০-৪৫ ধরে পচতে দেওয়া হয়। এই পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ট্রাইকো কম্পোস্ট সার তৈরি হয়।
উদ্যোক্তা সোলায়মান বলেন, সে স্নাতক শেষ করে চাকরি না করে কৃষিকাজে মনোযোগী হন। কৃষিকাজের পাশাপাশি সার ও বীজের ব্যবসা শুরু করেন। প্রথমে ২০১২ সালে ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) সার উৎপাদান করেন। ২০১৩ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তিনি ফিলিপাইন ও থাইলেন্ড গিয়ে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদনের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে ফিরে প্রায় তিন লাখ টাকা পুঁজি খাটিয়ে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করেন। প্রথম দুই মাস তিনি লোকসানে ছিলেন। তৃতীয় মাসে তিনি ৫০ হাজার টাকার সার বিক্রি করেন। তার পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ধীরে ধীরে তার এই উৎপাদিত সার কৃষকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
তিনি আরো বলেন, আমি যখন এই সার উৎপাদন শুরু করি তখন আমার পরিবারের লোকজন বলে আপনাকে দিয়ে এসব কাজ মানায় না। তবুও আমি তাদের কথা কর্ণপাত না করে সার উৎপাদনের দিকে এগিয়ে যাই।
এখন আমার মাসিক আয় গড়ে ১ লাখ টাকা। বর্তমানে আমার এ কাজে চারজন কর্মচারী কাজ করছেন। এবং আমার পরিবারে ৪ জন সদস্য রয়েছে। এ সার উৎপাদনে ভবিষ্যতে আমার বড় পরিকল্পনা রয়েছে। সরকার যদি মুনাফায় ঋণ দেয় ও প্যাকেজিংয়ের সুযোগ থাকে তাহলে আরও বৃদ্ধি করব।
এ সার ব্যবহার করার উপর সরকার বাইর থেকে সার আমদানি করতে হয়। এতে সরকার ভর্তুকি দিতে হয়। এটা যদি ছত্রাকের মাধ্যমে দেশেই উৎপাদন করা হয় তাহলে সরকারের জন্য সাশ্রয় হবে। যেখানে কৃষকরা ১ কেজি টিএসপি সার কিনছে ৩৫ টাকা করে, সেখানে আমার তৈরি ট্রাইকো কম্পোস্ট সার কিনছে ২০ টাকা করে।
তরমুজ চাষি আলমগীর বলেন, আমি কয়েক বছর ধরে তরমুজ চাষ করে আসছি। আগে জৈব সারসহ রাসায়নিক সার ব্যবহার করতাম। কিন্তু গাছের রোগবালাই হতো বেশি, ফল আকারে ছোট হত। তরমুজের গত মৌসুমে আমি উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার ব্যবহার শুরু করেছি। ফলন ভালো হওয়াতে লাভবান হয়েছি। মাটিতে আগের মতো কৃত্রিম সার দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি, ফলে খরচও কমেছে। আমি বলব, যারা এ সার ব্যবহার করেননি, তারা একবার হলেও সার ব্যবহার করতে পারেন।
বাদামচাষি আ. মালেক বলেন, আমি প্রতিবছর ৫ একর জমিতে বাদাম চাষাবাদ করছি। আমি আগে টিএসপি সার জমিতে ফেলেছি। যখন দেখলাম সোলায়মান ট্রাইকো কম্পোস্ট সার তৈরি করছে। এখানকার কৃষকরা তার কাছ থেকে সার কিনে উপকৃত হচ্ছে। আমিও ট্রাইকো কম্পোস্ট সার কিনে জমিতে ব্যবহার করেছি এবং বাম্পার ফলন হয়েছে। এ সার একেবারেই স্বল্প মূল্যে কেনা যায়, ফসলের জন্য বেশ ভালো।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নাজমুল হুদা বলেন, বর্তমানে টেকসই কৃষি ব্যবস্থার জন্য জৈব সার ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে এতে থাকা উপকারি অণুজীব মাটিতে পুষ্টি চক্রকে সক্রিয় করে তোলে, যা গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ফলনের জন্য সহায়ক। এ উপজেলার কৃষকদের অনেকেই এরইমধ্যে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার ব্যবহার শুরু করেছেন এবং তারা ইতিবাচক ফলাফল পাচ্ছেন। রাসায়নিক সারের ব্যবহারও অনেক কমে গেছে।
তিনি বলেন, আমরা কৃষি অফিস থেকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিচ্ছি, যাতে আরও বেশি কৃষক এ পরিবেশবান্ধব ও লাভজনক চাষপদ্ধতিতে আগ্রহী হন। ট্রাইকো কম্পোস্টের ব্যবহার সম্প্রসারণে ভবিষ্যতে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।