
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বের তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন আরও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও সাহসী হয়ে নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়। তিনি বলেন, তরুণদের মধ্যেই রয়েছে সমাজে অর্থবহ পরিবর্তন আনার শক্তি।
গত শনিবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সুইডেন ও নরওয়ের তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি এ আহ্বান জানান। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘অনেকে বলে তরুণরা ভবিষ্যৎ, আমি বলি—তরুণরাই বর্তমান।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আজকের তরুণরা আগের প্রজন্মের মতো নয়। প্রযুক্তির কারণে তোমরা এক নতুন প্রজাতির মানুষ—প্রায় ‘সুপারহিউম্যান’। শুধু নিজেকে প্রশ্ন করো, আমি কেমন একটি বিশ্ব গড়তে চাই? এরপর সেই লক্ষ্যে অঙ্গীকারবদ্ধ হও, কারণ তোমাদের হাতেই তা বাস্তবায়নের উপায় রয়েছে।’
সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস ও নরওয়ের হকন আরাল্ড গুলব্রান্ডসেনের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন সুইডেনের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরুণ নেতা—অ্যালিস ল্যান্ডারহোম (মডারেট ইয়ুথ পার্টি), আরিয়ান ত্বানা (সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ইয়ুথ পার্টি), অ্যান্টন হোল্মলুন্ড (লিবারেল ইয়ুথ পার্টি), ডেক্সটার ক্রোকস্টেড (সুইডেন ডেমোক্র্যাটস ইয়ুথ), হান্না লিন্ডকভিস্ট (গ্রিন ইয়ুথ পার্টি) এবং ম্যাক্স পেলিন (ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইয়ুথ পার্টি)।
নরওয়ের তরুণ নেতাদের মধ্যে ছিলেন ওদা রোহমে সিভের্তসেন (ইয়ং কনজারভেটিভস), লার্স মিকায়েল বারস্টাড লাভল্ড (প্রগ্রেস পার্টি ইয়ুথ) এবং সাইভার ক্লেভে কোলস্টাড (রেড ইয়ুথ)। প্রতিনিধিদের সঙ্গে ছিলেন জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার, নর্ডিক অফিসের উপপরিচালক ক্যারোলিন আবরগ, কৌশলগত যোগাযোগ ও বহিঃসম্পর্ক বিশেষজ্ঞ কীর্তিজয় পাহাড়ি এবং যোগাযোগ বিশ্লেষক এমিলি আন্দ্রেসেন।
সাক্ষাৎকালে প্রধান উপদেষ্টা তরুণ রাজনীতিকদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন। প্রতিনিধিরা জুলাই অভ্যুত্থান, তরুণদের অংশগ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তাঁর মতামত জানতে চান।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘জুলাই ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত—বিশেষ করে অসংখ্য তরুণ-তরুণী তখন এক ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। তোমরা এমন এক সময় এসেছো, যখন বাংলাদেশ ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আশা করি, তোমরা এখানকার তরুণদের সঙ্গে দেখা করবে এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা জানবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবীরা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবি তুলেছিল—বিশেষত সংবিধান সংশোধনের, যা তারা ফ্যাসিবাদের মূল কারণ হিসেবে দেখেছিল। আমরা ইতোমধ্যে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলতে আমরা গঠন করেছি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। ত্রিশটিরও বেশি দল মাসের পর মাস আলোচনায় অংশ নিয়েছে। অবশেষে সব দলের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। আমরা এ মাসেই জুলাই সনদ স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটি হবে আমাদের জাতির ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমি জানি না, অন্য কোনো দেশে এমন প্রক্রিয়া ঘটেছে কি না।’
প্রধান উপদেষ্টা তরুণ নেতাদের বাংলাদেশ ঘুরে দেখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এখানকার প্রতিটি রাস্তা একেকটি গল্প বলে। দেয়াললিখন, দেয়ালচিত্র সবই তরুণদের প্রতিরোধ ও স্বপ্নের জীবন্ত জাদুঘর।’
আলোচনায় অধ্যাপক ইউনূসের ‘থ্রি জিরোস’ ধারণা ও ‘সোশ্যাল বিজনেস’ ভাবনাও উঠে আসে। ‘থ্রি জিরোস’ ধারণায় রয়েছে শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ, শূন্য সম্পদণ্ডকেন্দ্রীভবন (দারিদ্র্য দূরীকরণ) এবং শূন্য বেকারত্ব (উদ্যোক্তা বিকাশের মাধ্যমে) যা একটি নতুন সভ্যতা গড়ার লক্ষ্য নিয়ে প্রণীত।
এদিকে ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামের ফ্ল্যাগশিপ ইভেন্টে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল রোববার সকালে ইতালির রাজধানী রোমের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সফরসূচি অনুযায়ী, মুহাম্মদ ইউনূস ফোরামের মূল অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ভাষণ দেবেন। পাশাপাশি তিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এসব বৈঠকে খাদ্যনিরাপত্তা, দারিদ্র্য নিরসন, টেকসই উন্নয়নসহ বৈশ্বিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে।
ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরাম জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম। এখানে বিশ্বের নীতিনির্ধারক, গবেষক ও উদ্যোক্তারা খাদ্যব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে মতবিনিময় করেন। এবারের ইভেন্টটি ১০ থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত রোমে এফএওর সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার এ সফরকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সক্রিয় কূটনৈতিক ভূমিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ১৫ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।