
বিমান বিধ্বস্তের ১২ দিন পর গতকাল রোববার সীমিত পরিসরে খুলেছে উত্তরার মাইলস্টোন কলেজ। প্রতিষ্ঠানটিতে বেলা ১১টার দিকে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল। তবে গতকাল হয়নি কোনো পাঠদান কার্যক্রম। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নিঃশব্দ শোকযাত্রার মতো শ্রেণিকক্ষে ফিরেছেন। নেই আগের সেই হৈ-হুল্লোড়, চারদিকে শুধু নিস্তব্ধতা। সকালে স্কুলটিতে গিয়ে দেখা যায়, সকাল ৯টা থেকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে আসতে শুরু করেন। শিক্ষার্থীরা একাডেমিক ভবনে যাওয়ার আগে বিমান বিধ্বস্তে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সামনে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছেন। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমার পাশের বাসার এক ছোট ভাই এখানে ক্লাস করতো। আন্টি ছোট ভাইয়াটাকে আমার সঙ্গে পাঠাতেন। আমি বড়, ওর খেয়াল রাখতে পারবো এজন্য। ও এখন বার্নে ভর্তি। এখনও সুস্থ না। এখানে এসে ওর কথা বারবার মনে পড়ছে। দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নওরোজ আফরিন বলেন, কলেজে আসতে কেমন ভয় লাগছিল তাও এলাম, আম্মু সঙ্গে এসেছে। পিচ্চিদের মুখগুলো চোখে ভাসছে। কান্না পাচ্ছে। এভাবে ওদের হারাতে হবে, তা কল্পনাও করিনি। হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেলো, ভাবতেই পারছি না।
কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম গতকাল সাংবাদিকদের জানান, আগামী বুধবার থেকে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হবে। একই সঙ্গে পরবর্তী তিন মাস শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার উন্নয়নে কাউনসেলিং কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
অধ্যক্ষ বলেন, ওই দিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস কার্যক্রম শুরু হবে। এরপর পরবর্তী অবস্থা বিবেচনায় বাকি ক্লাসগুলো চালুর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। গত ২১ জুলাই বেলা ১টা ৬ মিনিটে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি দোতলা ভবনে আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। এরপর বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। এতে বৈমানিক, শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ সেদিনই ২২ জন নিহত হয়। এতে স্কুলটির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, আয়াসহ ৩৪ জনের মৃত্যু ঘটে। অধ্যক্ষ জিয়াউল আলম বলেন, ঘটনার ভয়াবহতা কাটিয়ে শিক্ষার্থীদের ধীরে ধীরে শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনতে আমরা ধাপে ধাপে কাজ করছি। এখনও আমরা নিয়মিত ক্লাস শুরুর অবস্থায় যাইনি। আজ সোমবার ক্লাস থাকলেও তা হবে মূলত কাউন্সেলিংভিত্তিক। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন, তাদের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবেন। কেউ যদি এখনও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে বা আতঙ্কে থাকে, তাহলে আমরা তাকে ব্যক্তিগত কাউনসেলিংয়ে নিয়ে যাব। অধ্যক্ষ বলেন, ‘মূল পাঠদান কার্যক্রম শুরু হবে আগামী ৬ আগস্ট থেকে। এর আগে আমরা শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির সুযোগ দিচ্ছি।
শিক্ষকদের নির্দেশনা অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক ক্লাস নয় বরং শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করার একটি ধাপ হিসেবেই দিনটি কাজ করবে। এ ছাড়া আজ সোমবার আমাদের একটি পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষা রয়েছে। অধিকাংশ অভিভাবক চাইছেন, শিক্ষার্থীরা যেন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। তাদের মতে, শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরে এলে শিক্ষার্থীরা দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। গত এক সপ্তাহ ধরে আমরা অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানি, এই মুহূর্তে আমাদের পরিবারটি (মাইলস্টোন স্কুল) আহত এবং আমরা সবাই মানসিকভাবে কষ্টে আছি। আমরা সবার প্রতি কৃতজ্ঞ, যারা এই কঠিন সময়ে আমাদের পাশে থেকেছেন।’
জিয়াউল আলম বলেন, ‘আমরা তাদের প্রত্যেকের নাম, পরিচয় ও ছবি যাচাই-বাছাই করে সংগ্রহ করেছি এবং আমাদের কলেজের ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটে একটি অফিশিয়াল তালিকা প্রকাশ করেছি, যারা এই সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্ত ছিলেন বা বিভিন্ন গুজব শুনছিলেন, আশা করি এই তালিকা তাদের প্রশ্নের উত্তর দেবে। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মচারী এবং অভিভাবকদের নিয়ে গঠিত এই পরিবারে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের সবাইকেই আমরা কলেজের অংশ হিসেবেই মনে করি। তবে এর বাইরেও কেউ কেউ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন যেমন বিমানের পাইলট বা পথচারী কেউ কেউ।
তাদের পরিচয় এবং কলেজের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক না থাকায় আমরা তাদের কলেজের ক্ষয়ক্ষতির আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানে রাখিনি। এই মুহূর্তে কোনো শিক্ষার্থী নিখোঁজ নেই উল্লেখ করে অধ্যক্ষ বলেন, আপনারা যেভাবে আমাদের পাশে ছিলেন, যে সহানুভূতি ও সহযোগিতা দেখিয়েছেন, তার জন্য আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞ। আমরা শুধু এটুকুই চাই এই কঠিন সময়ে সবাই যেন ধৈর্য ও সহমর্মিতার সঙ্গে এগিয়ে আসেন এবং গুজব কিংবা অযাচিত আলোচনার বদলে বাস্তব সত্যের ওপরভিত্তি করেই মূল্যায়ন করেন। এই মুহূর্তে আমাদের কোনো শিক্ষার্থী নিখোঁজ নেই।