
সরকার, কারখানা মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর আইন প্রয়োগ, নিয়মিত পরিদর্শন, দুর্ঘটনার যথাযথ তদন্ত, দায়ীদের দ্রুত বিচারসহ কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের নেতারা।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তারা এই আহ্বান জানান। বক্তারা বলেন, সাম্প্রতিক কয়েক মাসে ঢাকার মিরপুরের পোশাক কারখানা, চট্টগ্রাম ইপিজেডের টাওয়েল ও চিকিৎসা সরঞ্জামের কারখানা এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ড ও রাসায়নিক বিস্ফোরণের ঘটনায় শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের প্রাণ ও সম্পদে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
এর আগে ২০১০ সাল থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত শিল্প দুর্ঘটনায় অন্তত ১৩১ জন নিহত ও ৫৭৮ জন আহত হয়েছে। এছাড়া, ২০১২ সালের আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস, ২০১০ সালের নিমতলী দুর্ঘটনা, ২০২২ সালের চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণসহ বিভিন্ন বড় দুর্ঘটনা প্রমাণ করে রাষ্ট্রীয় তদারকি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার পর প্রশাসন প্রায়ই তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু কমিটির রিপোর্ট সাধারণ জনগণের কাছে প্রকাশিত হয় না, সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না এবং দায়ীদের শাস্তি দিতে ব্যর্থতা দেখা যায়। এই ঘাটতি এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে পুনরায় একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে।
বক্তারা বলেন, মানুষের মৃত্যু, শ্রমিকদের পঙ্গুত্ব এবং পরিবারের দুর্দশা প্রশাসন ও ব্যবসায়িক লোভের কাছে তুচ্ছ বিষয় হয়ে গেছে। সংবাদ সম্মেলনে নেতারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, রাসায়নিক ও বিস্ফোরক পদার্থের নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক মানের নিয়মাবলী কার্যকর করতে হবে। জাতীয় আইন যেমন- বিস্ফোরক আইন, বয়লার আইন এবং শ্রম আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের জন্য আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী জীবনব্যাপী ক্ষতিপূরণ ও উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বক্তারা আরও বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনার রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা প্রয়োজন, যাতে তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় এবং দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত বিচার সম্ভব হয়। বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রাকৃতিক কারণে নয় বরং মানবসৃষ্ট কারণেই মৃত্যু হয়েছে। ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় বা দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার কারণে প্রকৃত দায়ীরা শাস্তি এড়াতে পারছে; যা পুনরাবৃত্তি রোধে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নেতারা বলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি কেবল কারখানার অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটি জাতীয় ইস্যু হিসেবে দেখা দরকার। প্রতিটি কারখানা এবং কমিউনিটি পর্যায়ে সেইফটি কমিটি গঠন এবং নিয়মিত অগ্নি মহড়া, ঝুঁকি বিশ্লেষণ ও মনিটরিং কার্যক্রমে স্থানীয় সরকার, কমিউনিটি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সম্পৃক্ততা জরুরি। ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় অগ্নি মহড়া এবং জরুরি প্রস্তুতির নিয়মিত আয়োজন দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি কমাতে সাহায্য করবে।
বক্তারা আরও উল্লেখ করেছেন, দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ শ্রমিক এখনও শ্রম আইনের সুরক্ষার বাইরে রয়েছেন। নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে শ্রমিক আহত বা নিহত হন, পরিবারে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধি পায় এবং শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের মতো নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিদেশি সহায়তায় প্রশিক্ষণ হয়েছে, তবে নিরাপত্তার বাস্তব পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তা অবহেলিত থাকায় তাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ।