
জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি এখন একযোগে সংকটে। তীব্র তাপপ্রবাহ, বায়ুদূষণ, এবং সংক্রামক রোগের বিস্তারে দেশের জনগণ যেমন ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে, তেমনি অর্থনীতিও হারাচ্ছে উৎপাদনক্ষমতা। দ্য ল্যানসেট কাউন্টডাউন অন হেলথ অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জের সদ্য প্রকাশিত ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে এসব আশঙ্কা উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, শুধু ২০২৪ সালেই তীব্র গরমে শ্রম উৎপাদনশীলতা হ্রাসে বাংলাদেশের সম্ভাব্য আয় ক্ষতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার- যা দেশের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে এক অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এর আয়োজন করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ (সি৩ইআর) ও দ্য ল্যানসেট কাউন্টডাউন গ্লোবাল টিম। সহযোগিতা দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিট।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ১৯৫০-এর দশকের তুলনায় বর্তমানে ডেঙ্গু সংক্রমণের উপযোগী আবহাওয়া বেড়েছে ৯০ শতাংশ। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, আর্দ্রতা, ও বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ঝুঁকি এখন মহামারি-সম পর্যায়ে পৌঁছেছে। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গ্রিনথাম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ও পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ড. সৌর দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, তাপপ্রবাহের কারণে যে শ্রমঘণ্টা হারাচ্ছে বাংলাদেশ, তা কেবল অর্থনীতির নয়- স্বাস্থ্য ব্যবস্থারও সতর্কবার্তা। তাপমাত্রা যত বাড়ছে, শ্রমিকদের উৎপাদনক্ষমতা, খাদ্যনিরাপত্তা, এমনকি চিকিৎসা-চাহিদাও তত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় ২০২৪ সালে তাপপ্রবাহের স্থায়িত্ব ও তীব্রতা বেড়েছে ৯২ শতাংশ। তাপজনিত কারণে মোট ২৯ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা ক্ষতি হয়েছে- যার ৬৪ শতাংশই কৃষিখাতে। এই ক্ষতির আর্থিক মূল্য আনুমানিক ২৪ বিলিয়ন ডলার, যা কৃষিখাতের মোট আয়ের ৫৫ শতাংশের সমান। প্রতিবেদনটি জানায়, ২০২৪ সালে প্রত্যেক বাংলাদেশি গড়ে ২৮.৮ দিন তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছেন, এরমধ্যে ১৩.২ দিন শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্টি। এতে গরমণ্ডসংক্রান্ত অসুস্থতা ও মৃত্যুঝুঁকি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে বহুগুণ। বায়ুদূষণের প্রভাবও ভয়াবহ। ২০২২ সালে মানবসৃষ্ট দূষণে ২ লাখ ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, যা ২০১০ সালের তুলনায় ৩৮ শতাংশ বেশি। এদের মধ্যে ৯০ হাজার মৃত্যু ঘটেছে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে, যার মধ্যে কয়লা একাই দায়ী প্রায় ৩০ হাজার মৃত্যুর জন্য।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মির্জা শওকত আলী বলেন, বায়ুদূষণ রোধে সাভারকে নিয়ন্ত্রিত বায়ুমান অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। ইটভাটা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। ঘরোয়া দূষণ কমাতে বৈদ্যুতিক চুলা চালুর উদ্যোগ নিয়েছি, যা অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সহায়তায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো থেকে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার এখনও মাত্র ০.৮৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে বাংলাদেশ খরচ করেছে ৮.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার- যা কার্বন নিঃসরণ হ্রাস উদ্যোগের সম্ভাব্য সাশ্রয়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, গত এক হাজার বছরে যা ঘটেনি, তা আগামী ৩০ বছরে ঘটবে।
তাপ, লবণাক্ততা, পানি সংকট- সব মিলিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য এখন জলবায়ুর সরাসরি আঘাতে আছে। তিনি জানান, উপকূলীয় এলাকায় পানির লবণাক্ততা ভয়াবহ আকার নিয়েছে। স্থানীয় মানুষ ছাদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ৩-৪ হাজার লিটারের ট্যাংক কিনছে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে। এদিকে, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক মিটারেরও কম উচ্চতায় বাস করছে। এতে লবণাক্ততা ও প্লাবনের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়েছে। এর সঙ্গে তাপপ্রবাহ ও সংক্রামক রোগের বিস্তার মিলে জনস্বাস্থ্য এখন ত্রিমুখী সংকটে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি. গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা মিশা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন আর ভবিষ্যতের বিষয় নয়- এটি চলমান জনস্বাস্থ্য সংকট। স্বাস্থ্যখাতকে ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যানে মূল অগ্রাধিকার হিসেবে যুক্ত করতে হবে। ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি নায়োকা মার্টিনেজ ব্যাকস্ট্রম বলেন, বাংলাদেশে আমরা জলবায়ু ও স্বাস্থ্য অভিযোজনকে একসঙ্গে দেখতে চাই।