
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম অগ্রনায়ক শহিদ ওসমানের রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে বাংলাদেশকে ইনসাফের রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে হবে বলে জানিয়েছেন ওসমান হাদির ভাই ওমর বিন হাদি। তিনি বলেন, আধিপত্যবাদমুক্ত ও ইনসাফভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই হবে ভাইয়ের রক্তের প্রকৃত মূল্যায়ন। এক শহীদের রক্তকে কেন্দ্র করে যে স্বপ্ন বোনা হয়েছিল, সেই স্বপ্নকে রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় রূপ দিতে হবে। গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্রে আয়োজিত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলন-২০২৫ এ দেওয়া বক্তব্যে ওমর বিন হাদি এসব কথা বলেন।
বক্তব্যের শুরুতে তিনি বলেন, সম্মেলনে দাওয়াত পেয়েছি শুনে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, বাবা, তোমার যাওয়ার দরকার নাই। আমি একটা ছেলেকে হারিয়েছি, তোমাকে আর হারাতে পারব না। ওমর জানান, তার মা আশঙ্কা করছেন, ভাইয়ের বিচারের দাবিতে সরব হলে তাকেও হত্যা করা হতে পারে। তিনি বলেন, আমি আম্মাকে না বলেই বাসা থেকে বের হয়েছি। আজ আমি ওসমানের ভাই হিসেবে নয়, বরং ওসমানের গর্বিত ভাই হতে চাই।
ওসমান হাদির স্মৃতিচারণ করে ওমর হাদি জানান, শাহবাগে ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগান দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সময় ওসমানকে অনলাইনে কাফনের ছবি পাঠিয়ে ভয় দেখানো হতো। তিনি বলেন, মেসেঞ্জারে কাফনের কাপড়ের বক্স পাঠিয়ে আমাদের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হতো। প্রথম দিকে ওসমান এসব শেয়ার করত, পরে আর করত না। অতীতের স্মৃতিচারণ করে তিনি জানান, ২০১২ সালে বাবার মৃত্যুর পর দুই ভাই একসঙ্গে পথ চলেছেন। জুলাই আন্দোলনের দিনগুলোতে রামপুরায় তারা একসঙ্গে পুলিশের বাধা, ভয় এবং অনিশ্চয়তাকে উপেক্ষা করে রাজপথে থেকেছেন। ৫ আগস্টের পর ব্যক্তিগত ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে তারা ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ প্রতিষ্ঠায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। আন্দোলনের সময় ওসমান তাকে ক্যামেরার আড়ালে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন জানিয়ে ওমর বলেন, ওসমান প্রায়ই বলত, ভাই, আমি যদি শহীদ হয়ে যাই, আন্দোলন আপনাকেই কন্টিনিউ করতে হবে। আপনি চেষ্টা করবেন ক্যামেরার আড়ালে থাকতে, যাতে মানুষ বুঝতে না পারে আপনি আমার ভাই।
তিনি আরও জানান, ভাইয়ের সেই নির্দেশই তাকে এতদিন আড়ালে রেখেছিল। কিন্তু হত্যার বিচার, রক্তের ঋণ, এবং ন্যায়বিচারের দাবি তাকে আজ সামনে নিয়ে এসেছে। ভাইয়ের শাহাদাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে ওমর বলেন, এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। খুনিরা ঘটনার দুই সপ্তাহ আগেই আমাদের নজরদারি করছিল। সেন্টারের ভেতরেও তাকে শুট করতে চেয়েছিল। একাধিকবার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত এক শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে ফেরার পথে ওসমান গুলিবিদ্ধ হয়। পরের শুক্রবার রাতে সিঙ্গাপুরে তিনি শহীদ হন।
তিনি বলেন, যে স্বাধীন বাংলাদেশে খুনিরা হত্যার ৬ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়, আর আল্লামা সাঈদী, যিনি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী, তাকে ভারতের কারাগারে পাওয়া যায়, সেই দেশে স্বাধীনতার অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। সম্মেলনে উপস্থিত ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ওসমানের চিন্তা, আদর্শ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে দিতে হবে। আমরা আর পরিবারের কান্না, আহাজারি দেখতে চাই না।
তিনি জানান, ১৬ বছর ধরে মানুষের বাক্?স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। “আজও নির্বাচন বা পরবর্তী সরকারের অজুহাতে অনেকেই মানুষের কণ্ঠরোধ করতে চায়। কিন্তু এ দেশের মালিক জনগণ। কোনো সরকার আসবে, তা জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে। আঁতাত ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কতা জানিয়ে ওমর বিন হাদি বলেন, আপনারা যদি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র হোক বা অভ্যন্তরীণ কোনো শক্তি কারো সঙ্গে আঁতাত করে এ দেশে পুনরায় ফ্যাসিবাদ কায়েমে সহযোগিতা করেন, তবে আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবেন।
তিনি আরও বলেন, ওসমানের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশকে আধিপত্যবাদমুক্ত করতে হবে এবং এখানে ইনসাফ কায়েম করতে হবে।