ঢাকা রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গ্রীষ্মের মুগ্ধ প্রকৃতি

আবু তাকরিম
গ্রীষ্মের মুগ্ধ প্রকৃতি

রূপের পালাবদলে গ্রীষ্মকাল বাংলার বুকে কাঠফাটা রোদ্দুর আর অসহ্য গরম নিয়ে জানান দেয়। কখনও কখনও প্রকৃতি রুদ্ররূপ ধারণ করে। প্রকৃতি যতই তার অগ্নিমূর্তি ধারণ করুক না কেন, বাস্তবে এর তপ্ত প্রকৃতি কোনো না কোনোভাবে সবাইকে মুগ্ধ করে। গ্রীষ্মের খা-খা অবস্থার মধ্যেও প্রকৃতি জুড়ে বয়ে বেড়ায় সবুজ পত্রপল্লবের দুলুনি, বিহঙ্গের শান্ত কূজন, বিস্তৃত খেতজুড়ে সোনালি ধানের ঢেউ ও রং-বেরঙের ফুল-ফলের মন মাতানো ঘ্রাণ। এ সময় গাছের নিচে ক্লান্ত পথিকের মনজুড়ানো দৃশ্যও খুব সাধারণ। সবুজ পাতারা ত্রাহি পথিককে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে যেন ধন্য হয়। গ্রীষ্মের মতো অপরিসীম নান্দনিকতা আর কোনো ঋতুতে খুঁজে পাওয়া যায় না। কবি-সাহিত্যিকরা গ্রীষ্মের রূপবৈচিত্র্যে বিমোহিত হয়েছেন বারবার।

গ্রীষ্মে বৃষ্টিবিলাস : সূর্যকিরণের দাবদাহ নিয়ে সবাই যখন অতিষ্ঠ, তখন হাহাকার করা প্রকৃতিতে চলে বৃষ্টির বন্দনা। গ্রীষ্মে বৃষ্টির বন্দনায় মাতেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রখর তপনতাপে চারদিক যখন ঝলসে যায়, মাঠ-ঘাট চৌচির হয়ে যায়, তখন আকাশে দেখা যায় কালো মেঘের ঘনঘটা। কালবৈশাখী ঝড় যেন তার রুদ্রমূর্তি নিয়ে হাজির হয়। কখনও কখনও বজ্রপাতের দাপট পরিশ্রমী কৃষককে চোখ রাঙায়। নগর জীবনে এক পশলা বৃষ্টিতে ছাদে ছাদে চলে বৃষ্টিবিলাস। এ শুভ্র মেঘ তো পরমুহূর্তে কালো মেঘ থেকে অঝোর বর্ষণধারা। গ্রীষ্মে বৃষ্টি উপেক্ষা করে কৃষকরা পাকা ধান ঘরে তুলতে মেতে ওঠে।

ফুল-ফলের মুগ্ধতা : গ্রীষ্মে প্রকৃতিপ্রেমীরা হরেক রকমের পুষ্পের বন্দনায় মেতে ওঠে। সবুজের নান্দনিকতার মাঝে শুভ্র, লাল, হলুদের পসরা। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুর জনজীবনে অস্বস্তি আনলেও মৌসুমের ফুল-ফলের প্রেমে পড়ে আবিষ্ট সবাই। হরেক রকমের নজরকাড়া ও মনজুড়ানো ফুল ফোটে এ সময়। লাল ও হলুদ রঙের কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে প্রকৃতির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয় হলুদ রঙের সোনালু, বেগুনি রঙের জারুল ও হলুদণ্ডলাল রাধাচূড়া। এছাড়া কনকচূড়া, গন্ধরাজ, স্বর্ণচাপা, উদয়পদ্ম, গুলাচি, নাগেশ্বর, গুস্তাভিয়া, মধুমঞ্জুরি, লালসোনাইল, কুরচি, মেঘশিরীষ, রক্তিম গুলবাহার, ডুলিচাপা, ঝুমকোলতা, হিজল, বরুণ, কাঠগোলাপসহ বিভিন্ন ফুলের সৌন্দর্যে প্রফুল্লিত হয়ে ওঠে প্রকৃতিপ্রেমীর অন্তর। প্রকৃতিপ্রেমীদের বলতে শোনা যায়, বর্ষার ফুল যেমন কদম, তেমনি গ্রীষ্মের মূল আকর্ষণ কৃষ্ণচূড়া। গ্রীষ্মে লাল কৃষ্ণচূড়া আর সোনালু ফুলে বিমোহিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কৃষ্ণচূড়ার প্রশংসা করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সোনালু ফুলের প্রেমে পড়েছেন। পুরো গ্রীষ্ম জুড়ে সোনালু ফুলের রেশ থাকে। প্রকৃতির এমন সতেজ ও সাজানো রূপ দেখে গ্রীষ্মের রুক্ষতা ভুলে থাকে সবাই। অযত্নে-অবহেলায় হলেও গ্রীষ্মের ফুলেল রূপ তার সৌন্দর্য জানান দেবেই। গ্রীষ্মের ফুল শুধু সৌন্দর্য বিলায় না, কিছু কিছু ফুলের ওষুধি গুণও রয়েছে।

রসালো ফল গ্রীষ্মের আকর্ষণ : গ্রীষ্মকাল মানেই চারপাশে মণ্ডম সুঘ্রাণের ছড়াছড়ি। গ্রীষ্ম মানেই সবার কাছে মধুমাস জ্যৈষ্ঠের টসটসে রসালো ফলের সমাহার। অনেকের কাছে গ্রীষ্ম মানেই শুধু আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ আর আনারসের মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ। গ্রীষ্মের ফল খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেননি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাঙ্গি আর তরমুজ তো তৃষ্ণার্থ প্রাণে একটুকরো শীতলতার পরশ। কাঁচা-পাকা আম আর টকটকে লাল লিচুর স্বাদ শুধু গ্রীষ্মতেই পাওয়া যায়। এছাড়া আতা, গাব, খুদিজাম, করমচা, বেল, জামরুল, আমলকি, পেয়ারা, পেঁপে, কলা, নারকেল, সফেদা, তালশাঁস, লেবু, কামরাঙা, ড্রাগন, ডেউয়া, তৈকর, প্যাশন, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, চুকুর, আঁশফল, ফলসা, হামজাম, বৈঁচি, লুকলুকি, বেতফল, মুড়মুড়ি, খেজুর, ননিফল, শরিফা ইত্যাদি গ্রীষ্মকালীন ফল। গ্রীষ্মের ফলফলাদি নিয়ে একে অন্যের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আসা-যাওয়া যেন বাংলার প্রাচীনকালের ঐতিহ্য। গ্রীষ্মকালের দাবদাহ যতই আমাদের অস্বস্তি তৈরি করুক, একবার কী ভেবে দেখেছি, যদি গ্রীষ্মকাল না থাকত, তাহলে আমরা এত এত ফুল আর ফলের সমাহার কোথায় পেতাম! তাই গ্রীষ্মকে আলিঙ্গন করে এর সৌন্দর্য উপভোগের এখনই সময়।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত