ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পশুর বর্জ্য যত্রতত্র ফেলা নিষেধ

মিজান ইবনে মোবারক
পশুর বর্জ্য যত্রতত্র ফেলা নিষেধ

কোরবানি মুসলমানদের জন্য এক পবিত্র ও আনন্দময় উৎসব; যা আত্মত্যাগ, তাকওয়া ও সমাজকল্যাণের মহান শিক্ষা দেয়। প্রতিবছর ঈদুল আজহায় মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করে থাকে। এ ইবাদতে বাহ্যিক দিকের পাশাপাশি রয়েছে সামাজিক ও পরিবেশগত দিক। কোরবানির পর পশুর বর্জ্য যত্রতত্র ফেলে রাখা যেমন অস্বাস্থ্যকর, তেমনি এটি ইসলামের পরিচ্ছন্নতার পরিপন্থি। ইসলাম পরিচ্ছন্নতা, সৌন্দর্য ও পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। কোরবানির প্রকৃত তাৎপর্য তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রতিফলন ঘটায়। তাই পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ও পরিবেশ রক্ষা করাও এ ইবাদতের অংশ। ইসলামে এর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

ইসলামে পরিচ্ছন্নতার নির্দেশনা : ইসলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ব্যক্তি, সমাজ ও পরিবেশের জন্য সৌন্দর্যের প্রতীক। পবিত্রতা, পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতা একজন প্রকৃত মোমিনের পরিচয়; তার ঈমানেরই বহিঃপ্রকাশ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক।’ (মুসলিম : ২২৩)। কোরআনে আল্লাহতায়ালা পবিত্রতা অবলম্বনকারীদের প্রশংসা করেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্রতা অবলম্বন করেন, তাদেরও ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা : ২২২)। আল্লাহ মানবজাতিকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র জীবনযাপনের শিক্ষা দিতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমার পোশাক-পরিচ্ছদকে পবিত্র রাখ। যাবতীয় মলিনতা ও অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক।’ (সুরা মুদ্দাসসির : ৪-৫)। ইসলামে পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বিস্তৃত ও সর্বব্যাপী। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, ঘরের পরিচ্ছন্নতা এবং পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা সবগুলোই ইসলামের দৃষ্টিতে সমান। একজন মোমিন তার আশপাশ, সমাজ ও পরিবেশের দিকেও সমানভাবে যত্নবান থাকেন। কোরবানির পশু জবাইয়ের পরপরই সেই স্থান পরিষ্কার করা, বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে ফেলা এবং পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা এসবই পরিচ্ছন্নতার বাস্তব প্রয়োগের অন্যতম ক্ষেত্র। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা যথাসাধ্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাক। কারণ, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পরিচ্ছন্নতার ওপর। পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি ছাড়া কেউই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (জামে সাগির : ৩০১)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্রতাকে ভালোবাসেন। আল্লাহ পরিচ্ছন্ন। তিনি পরিচ্ছন্নতাকে ভালোবাসেন। অতএব, তোমরা তোমাদের উঠোনগুলো পরিচ্ছন্ন রাখ।’ (তিরমিজি : ২৭৯৯)। কোরবানির পশু জবাই করার পর?ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি খেয়াল রাখা একজন মোমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা মহাপাপ : কোরবানি আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের মহান উপলক্ষ। এ ইবাদত যেন কারো কষ্টের কারণ না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রতিটি মোমিনের ঈমানি দায়িত্ব। বাস্তবে দেখা যায়, অনেকেই কোরবানির পশু জবাইয়ের পর রক্ত, নাড়িভুঁড়ি, চামড়া, হাড়, পলিথিনসহ নানা ধরনের বর্জ্য রাস্তাঘাট, ড্রেন বা খোলা জায়গায় ফেলে রাখেন। এটি শুধু অসচেতনতার পরিচায়ক নয়, ইসলামি আদর্শেরও বিপরীত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার কষ্ট থেকে আশপাশের মানুষ নিরাপদ নয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’(বোখারি : ৫/২২৪০, মুসলিম : ১/৬৮)। রাস্তাঘাটে পড়ে দীর্ঘসময় ধরে এসব বর্জ্য পরিবেশ দূষণ করে। পানির স্তর ও মাটির গুণগত মান নষ্ট করে। আশপাশের প্রাণিকুলের ওপরও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। এতে যেমন দুর্গন্ধ ছড়ায়, তেমনি সৃষ্টি হয় রোগজীবাণুর ঝুঁকি, মশা-মাছির উপদ্রব এবং আশপাশের মানুষের দুর্ভোগ। ফলে যে কোরবানি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয়, তা অসচেতন আচরণের কারণে মানুষের কষ্টের ও গোনাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যকে কষ্ট দেওয়া ইসলামধর্মে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করা উভয়ই হারাম।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৩৪০)। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করে বলেন, ‘তোমরা ওই দুটি অভিশপ্ত কাজ থেকে বেঁচে থাক।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী সেই অভিশপ্ত কাজ?’ তিনি বললেন, ‘মানুষ চলাচলের পথ ও ছায়াযুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করা।’ (মুসলিম : ২৬৯)। এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, মানুষের চলাচলের স্থান কিংবা যেখানে তারা বিশ্রাম নেয়, সেখানে কোনো নোংরা ময়লা-আবর্জনা ফেলা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কোরবানির বর্জ্য পরিষ্কার না করা বা রাস্তায় ফেলে রাখা তেমনই এক কাজ, যা মানুষকে কষ্ট দেয়।

যথাস্থানে বর্জ্য ফেলার উপকারিতা : রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বদাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকতেন। পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান। কোথাও কোনো অপরিচ্ছন্নতা দেখলে তিনি তা পরিষ্কার করতে তাগিদ দিতেন। রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখা, দুর্গন্ধ বা বর্জ্য অপসারণ করাও একজন প্রকৃত মোমিনের কাজ। একে ঈমানের একটি শাখা উল্লেখ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঈমানের সত্তরোর্ধ্ব কিংবা ষাটোর্ধ্ব শাখা রয়েছে। তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠতম শাখা হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা, আর সবচেয়ে সাধারণ শাখা- রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া।’ (মুসলিম : ৩৫)। কোরবানির পর রাস্তায় রক্ত, হাড়গোড়, নাড়িভুঁড়ি ফেলে রাখা তো সরাসরি কষ্টদায়ক বস্তু ছড়িয়ে দেওয়ার শামিল। এর অপসারণের ফজিলত বর্ণনা করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পথের কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া সদকা।’ (মুসলিম : ১০০৯)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘সূর্যোদয়ের প্রতিটি দিনে মানুষের প্রতিটি অঙ্গের ওপর সদকা ওয়াজিব হয়। রাস্তাঘাট থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলাও সদকা।’ (বোখারি : ২৯৮৯, মুসলিম : ১০০৯)। তাই কোরবানির পশুর বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে ফেলা, পরিবেশ পরিষ্কার রাখা এবং এ ব্যাপারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করাও একপ্রকার ইবাদত। যারা কোরবানির পরে যাবতীয় অনুষঙ্গ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে, হাদিসে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে। কোরবানি একটি মহান ইবাদত। এ কাজের সঙ্গে যুক্ত পরিচ্ছন্নতাও আমাদের কর্তব্যের অংশ। পশু জবাইয়ের পর স্থানটি পরিষ্কার করা, পানি ছিটিয়ে গন্ধমুক্ত রাখা, বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে ফেলাও আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ।

লেখক : আলেম ও প্রাবন্ধিক

পশুর বর্জ্য,কোরবানি,ঈদুল আজহা,মহান শিক্ষা,সমাজকল্যাণ,তাকওয়া,আত্মত্যাগ,পবিত্র ও আনন্দময় উৎসব
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত