কাশ্মীরে ইসলাম প্রধান ধর্ম। ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান হিসেবে, এ অঞ্চলের জনসংখ্যার ৯৭.১৬ শতাংশ মুসলমান। চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে মধ্য এশিয়া ও পারস্য থেকে মুসলিম সুফি প্রচারকরা এ অঞ্চলে আসেন। তাদের দ্বারাই এখানে ইসলামের আগমন ঘটে। কিছুকাল আগে কাশ্মীরি মুসলমানদের বেশিরভাগই সুন্নি ধর্মাবলম্বী ছিল; কিন্তু এখন দ্রুত ব্যবসার প্রভাবে কাশ্মীরি শিয়া জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ এবং তা ক্রমশ দ্রুত বাড়ছে। কাশ্মীরের অকাশ্মীরি মুসলমানদের মধ্যে গুর্জর ও বাকরওয়াল সম্প্রদায়ের অর্ধ-যাযাবর গোয়াল ও মেষপালকরা অন্তর্ভুক্ত।
ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের সূচনা : অষ্টম শতাব্দীতে কাশ্মীর রাজ্য বেশ কয়েকবার আক্রান্ত হয়। উমাইয়া খলিফারা তুর্কিস্তান, কাবুল ও কাশগর জয় করেছিলেন। তাদের বিজয়গুলো প্রাথমিক আব্বাসীয়রা আরও সংঘটিত করেছিল। ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে আরবরা চীনাদের ওপর জয় অর্জন করেন। তাদের পশ্চিমের গিলগিট ও অন্যান্য অঞ্চল ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। এ জয়গুলো আরবদের কাশ্মীর রাজ্যের আশপাশে নিয়ে আসে। তবে উত্তর থেকে এর আক্রমণের চেষ্টা করা হয়নি। আরবরা কাশ্মীর জয়ের বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা করেছিলেন। শেষমেশ মুহাম্মদ বিন কাসেমের নেতৃত্বে সিন্ধুতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজা চন্দ্রপীদার রাজত্বকালে মুহাম্মদ বিন কাসেম মুলতান থেকে কাশ্মীর রাজ্যের সীমানায় এগিয়ে আসেন। আরবদের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য চাইনিজ সম্রাটের কাছে রাষ্ট্রদূত পাঠান। কিন্তু কোনো সাহায্য মেলেনি। উমাইয়া খলিফার ডাকে মুহাম্মদ বিন কাসেম ফিরে যান। তাই সম্ভাব্য আক্রমণ এড়ানো হয়।
কাশ্মীরের দিকে পুনঃযাত্রা : খলিফা হিশামের রাজত্বকালে আরবরা গভর্নর জুনায়েদের উচ্চাভিলাষী ও উদ্যমী নেতৃত্বে আবারও কাশ্মীরের দিকে যাত্রা করেন। কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য মুক্তাপিদা (৭২৪-৬০ খ্রিষ্টাব্দ) জুনায়েদকে পরাজিত করেন। রাজ্য দখল করে নেন। এ জয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ, আরবদের দ্বারা আবারও আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করা হয়। ললিতাদিত্য এ আক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম হয়। খলিফা মানসুর (৭৫৪-৭৫ খ্রিষ্টাব্দ)-এর মাধ্যমে নির্ধারিত সিন্ধু রাজ্যপাল হিশাম ইবনে আমর আত-তাগলিবি কাশ্মীর রাজত্বে আক্রমণের শেষ চেষ্টা করেন। হিমালয়ের দক্ষিণ ঢাল পর্যন্ত পৌঁছান; কিন্তু প্রবেশে ব্যর্থ হন। উপত্যকাটি দখলের সুযোগ হয়নি।
গজনিদের কাশ্মীর জয়ের চেষ্টা : আরবদের পরে গজনিরা কাশ্মীর জয়ের চেষ্টা করে। গজনীর মাহমুদ ওয়াহিন্দের শাসক রাজা জয়পালকে (১০০২ খ্রিষ্টাব্দ) আধুনিক পাকিস্তানের পেশোয়ারের কাছে পরাজিত করেন। জয়পালের পুত্র ও উত্তরসূরি আনন্দপালও ১০০৯ খ্রিষ্টাব্দে মাহমুদের হাতে পরাজিত হন। এর কয়েক বছর পরে মারা যান। আনন্দপালের পুত্র ত্রিলোচনপাল মাহমুদের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য কাশ্মীরের রাজা সমগ্রামরাজের (১০০৩-২৮ খ্রিষ্টাব্দ) কাছে আবেদন করেন। ত্রিলোচনপালের বাহিনীতে যোগ দিয়ে সমগ্রামরাজ একটি বিশাল সেনাদল পাঠান। সুলতান মাহমুদের একটি শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়। তা দেখে মাহমুদ ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হন। ১০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ত্রৈলচঞ্চলকে পরাজিত করেন। সামগ্রামরাজের আচরণে মাহমুদ কাশ্মীর আক্রমণ ও তাকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তোসাময়দান দিয়ে রাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তার অগ্রগতি শক্তিশালী লোহারকোট দুর্গ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়। যেখানে তিনি একমাসের জন্য আটকে রেখেছিলেন। প্রবল তুষারপাতের কারণে মাহমুদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন। সুলতান আবার ১০২১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে কাশ্মীর আক্রমণের জন্য যাত্রা করেন। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার ফলে আবারও পিছিয়ে যেতে বাধ্য হন।
বৌদ্ধদের হাতে শাসনক্ষমতা : সুলতান মাহমুদের কাশ্মীরে আক্রমণের চেষ্টার পরে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কাশ্মীর সাধারণভাবে প্রভাবিত ও অপরিবর্তিত ছিল। কারণ, ভারতের সমভূমিগুলোতে অভিযান চালানো হয়েছিল। লোহারাসরা (১০০৩-১৩২০) সময়কালে শাসন করেছিল। তারাই হিন্দুদের সর্বশেষ রাজবংশ ছিল। ১৩২০ সালের বসন্তে জুলকাদার খান তুর্ক (জুলচা খান) নামে এক তুর্কিস্তানি সরকারি ঝিলাম উপত্যকা হয়ে কাশ্মীর আক্রমণ করেন। লোহারাসের শেষ শাসক সুহাদেব (১৩০১-২০ খ্রিষ্টাব্দ) প্রতিরোধ সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু জনগণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা না থাকায় ব্যর্থ হন। জুলচা খানের আক্রমণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সহদেব কিস্তার পালিয়ে যান। আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য রামচন্দ্র (কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী) দ্বারা নিযুক্ত লাদাখি প্রধানের পুত্র রিঞ্চনা বিশৃঙ্খলার সুযোগ নেন। তিনি রামচন্দ্রকে খুন করে ১৩২০ সালের শেষদিকে কাশ্মীরের সিংহাসন দখল করেন। ১৩২৩ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত শাসন করেন। কাশ্মীরিদের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্য তিনি রামচন্দ্রের কন্যা কোটা রানিকে বিয়ে করেন। রাবণচন্দ্রকে (রামচন্দ্রের ছেলে) প্রধান সেনাপতি পদে বসান।
ইসলামের সুশীতল ছায়া : সুহাদেবের রাজত্বকালে কাশ্মীরে আসেন বুলবুল শাহ। তার মূল নাম সাইয়িদ শরফুদ্দিন। তার সংস্পর্শে রিঞ্চনা ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর সুলতান সদরুদ্দিন শাহ নাম ধারণ করে কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হন। রিঞ্চনার ধর্মান্তরের পর তার সেনাপ্রধানও মুসলিম হন। ইসলামের এ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন রূপান্তর হয়। অনেক কাশ্মীরি বুলবুল শাহের ধর্মকে গ্রহণ করে। সুলতান সদরুদ্দিনের মৃত্যুর পরের সময়টি বিশৃঙ্খলা ও শক্তি-কোন্দল দ্বারা চিহ্নিত হয়। অভিজাতদের মধ্যে এক চুক্তির পরে সুহাদেবের ভাই উদয়ন দেবকে শাসক করা হয়। তবে তিনি অযোগ্য ছিলেন। তাই কোটা রানি শাসক হন। উদয়ন দেবের অধিগ্রহণের পরপরই একজন বিদেশি সেনানায়ক কাশ্মীর আক্রমণ করে। কিন্তু আক্রমণকারীরা সফলভাবে বিতাড়িত ও পরাজিত হয়। প্রশাসন আবারও বিশৃঙ্খলায় পড়ে। আক্রমণ দেখে উদয়ন দেব দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। অভিজাতদের চোখে তিনি তার সুনাম হারান। শেষমেষ ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান। কোটা রানি সিংহাসনে বসেন। সুহাদেবের নিযুক্ত অভিজাত শাহ মীর ও কোটা রানির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৩৩৯ খ্রিষ্টাব্দে শাহ মীর সিংহাসন দখল করেন। সুলতান শাহ মীর প্রতিষ্ঠিত শাহমিরি রাজবংশ (১৩৩৯-১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দ) পরবর্তী ২২২ বছর কাশ্মীর শাসন করেন।
কাশ্মীরে ইসলাম প্রচারে অবদান : কাশ্মীরে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশি অবদান ইসলাম প্রচারক সুফি-দরবেশদের। মুসলিম শাসকরাও এ ক্ষেত্রে অনন্য ও অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। একসময় কাশ্মীরের জনগণের একাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। হিন্দুর সংখ্যাও বৌদ্ধদের চেয়ে কম ছিল না। এ বৌদ্ধ ও হিন্দু জনগোষ্ঠী কালক্রমে প্রায় শতভাগ ইসলামের অনুসারী হয়ে যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইসলাম যেখানেই বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে স্থানীয়দের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর হস্তক্ষেপ করেনি। ইসলামের মূল শিক্ষা, দর্শন ও অনুসরণীয় অপরিহার্য বিষয়গুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়াবলি শুধু নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও এটা লক্ষ্যণীয়। কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা বিনষ্ট না করে ইসলামের সঙ্গে বিরোধীয় নয়, এমন অনুসরণীয় আচার-সংস্কৃতির ওপর আঘাত না হেনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করেন মুসলমান শাসকগণ। তাদের দিকনির্দেশনা দেওয়াসহ সব ধরনের সহযোগিতা করেন তারা সুফি-দরবেশরা।
প্রথমবারের মতো ইসলাম : ১১১৮ সালে মধ্য এশিয়া থেকে আসেন জুল কদর খান। যিনি তাতার জুলজু নামেও পরিচিত। কাশ্মীরে অভিযান চালান। তার কয়েক মাসের অভিযানের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কাশ্মীরিদের সঙ্গে ইসলামের পরিচয় ঘটে। তবে কাশ্মীরে ইসলামের গভীর প্রভাব বিস্তৃত হয় অষ্টম শতকের পরে। এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন দুজন সুফি সাধক। এদের একজনের নাম বুলবুল শাহ কলন্দর, অন্যজনের নাম সাইয়িদ আলী হামাদানি। বুলবুল শাহ কলন্দর ইরান বা মধ্য এশিয়ার কোনো দেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য কাশ্মীরে আসেন। তার প্রচারকর্মের মধ্য দিয়ে ইসলামের প্রসার ঘটতে থাকে। তখন কাশ্মীরের শাসক ছিলেন বৌদ্ধ রাজা রিঞ্চনা। তিনি বুলবুল শাহ কলন্দরের কাছে সপরিবারে ইসলামে দীক্ষিত হন। এটা ছিল সে সময় বিপুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। কাশ্মীরি সমাজে এর ফলে এক বিরাট পরিবর্তন হয়। রাজার অনুসরণে জনসাধারণের বিরাট অংশ ইসলামে দীক্ষিত হয়। রাজা রিঞ্চনা সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, তিনি ছিলেন লাদাখের অভিজাত পরিবারের সন্তান। বিশ্বাসের দিক থেকে ছিলেন বৌদ্ধ। কিন্তু উপত্যকায় তাদের সংখ্যা ছিল কম। অধিকাংশ কাশ্মীরি ছিল ব্রাহ্মণ। এমতাবস্থায় তিনি দেবস্বামী ব্রাহ্মণ সমাজের প্রধানের কাছে অনুরোধ করেন, তাদের সমাজে তাকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে। তার এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর তিনি সপরিবারে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার মুসলমান নাম শামসুদ্দিন। কারো কারো মতে, সদরুদ্দিন। এরপর থেকে পরবর্তী কয়েক শতকে কাশ্মীরে ইসলামের নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠা হয়। এ সময় বহু সুফি-দরবেশের কাশ্মীরে আগমন ঘটে। তারা ইসলামের প্রচার ও শিক্ষা বিস্তারে নিরলস ভূমিকা পালন করেন।
কাশ্মীরের অনন্য ধর্মপ্রচারক : ঐতিহাসিকদের মতে, বুলবুল শাহ কলন্দরের পর ইসলাম প্রসারে যার সবচেয়ে বেশি অবদান, তিনি হলেন সাইয়িদ আলী হামাদানি। তখন কাশ্মীরের শাসক ছিলেন সুলতান সিকান্দর শাহ (১৩৯৩-১৪১৩)। তিনি হামাদানির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। কাশ্মীরের সংস্কৃতিতে হামাদানির প্রভাব এখনও রয়েছে। কাশ্মীরের শিক্ষা ও অর্থনীতিতে তার অবদান ঐতিহাসিকভাবে স্মরণীয়। তিনি ইরান থেকে বেশ কিছু অনুসারী নিয়ে এসেছিলেন। যাদের মধ্যে ছিলেন জ্ঞানী, গুণী, বিদ্বান ও শিল্পী। কাশ্মীরে কার্পেট ও শাল-শিল্পের সূচনা হামাদানির অনুসারীদের হাতে। যা শত শত বছর ধরে কাশ্মীরি ঐতিহ্য ও অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ। আধ্যাত্মিকতা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে অসাধারণ অবদান রয়েছে হামাদানির। শুধু কাশ্মীর নয়, মধ্য এশিয়াজুড়ে তার আধ্যাত্মিক প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে। তিনি এখনও অনুসারিত হয়ে থাকেন। বর্তমান পাকিস্তানের হাজারা জেলায় তার মৃত্যু হয়। তাকে সমাহিত করা হয় কাজাখস্তানে। মৃত্যুর পর তার ছেলে মীর মুহাম্মদ হামাদানি পরবর্তী ২২ বছর বাবার মতোই ইসলাম প্রচারে ভূমিকা রাখেন।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক