ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হারিয়ে যাওয়া প্রাণী

তাবাসসুম মাহমুদ
হারিয়ে যাওয়া প্রাণী

জীববৈচিত্র্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিলুপ্ত হচ্ছে নানা প্রজাতির প্রাণী। অস্তিত্ব সংকট ও হুমকির মধ্যে রয়েছে প্রাণিসম্পদ। গত ২০০ বছরে বিলুপ্ত হয়েছে অন্তত ৩০০ প্রজাতির প্রাণী। ঝুঁকিতে আছে আরও শ’খানেক। প্রকৃতির প্রতি মানুষের শাসন, পরিবেশ দূষণ ও পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে পরিবেশ বিপর্যয় জোরালো হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। হারিয়ে যেতে পারে অতি পরিচিত প্রাণীও। আগামী কয়েক বছরে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কয়েক দশক ধরেই ধারাবাহিকভাবে কমেছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা। ১১ বছরে ৩৩৪টি বাঘ কমেছে। বর্তমানে এ সংখ্যা ১০৬। ১৯৮০ সালের পর এ পর্যন্ত সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ৭০টি বাঘ মারা গেছে। মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব বা খাদ্যের অভাবে কমেছে হাতির সংখ্যাও। সবমিলিয়ে সারা দেশে ২০০-এর বেশি হাতি নেই।

বিলুপ্ত হচ্ছে নানা প্রজাতির প্রাণী : প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী শকুন প্রায় বিলুপ্তির পথে। টিকে থাকা শকুনের সংখ্যা কোনোক্রমেই ৩০০-এর বেশি হবে না। বৃষ্টিভেজা রাতে ঘরের পাশে এখন আর আগের মতো শোনা যায় না ব্যাঙের ডাক। ক্রমাগত বিলুপ্ত হচ্ছে ব্যাঙের নানা প্রজাতি। কমেছে কাছিমের সংখ্যাও। হারিয়ে যাচ্ছে জাতীয় পাখি দোয়েল। এখনও সুন্দরবনে অবৈধভাবে হরিণ শিকার হয়। ফলে বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মতে, সংরক্ষণ ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে মোট বন্যপ্রজাতির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আগামী কয়েক বছরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তাদের মতে, বিদ্যমান পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে যে হাজারখানেক প্রজাতির বন্যপ্রাণী টিকে আছে, যারা পরিবর্তিত পরিবেশে বিপন্ন। অর্ধেক প্রজাতিই এখন কোনো না কোনো ধরনের হুমকির সম্মুখীন।

বিলুপ্ত হওয়া প্রাণীর পরিসংখ্যান : ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশ ও দ্য ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন বাংলাদেশ শাখার এক জরিপের তথ্য থেকে জানা যায়, গত ২০০ বছরে বিলুপ্ত হয়েছে অন্তত ৩০০ প্রজাতির প্রাণী। দেড়শ’ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ১৩ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী, ৪৭ প্রজাতির দেশি পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর, ৬৩ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১০ স্তন্যপায়ী প্রাণীর ১০টি মিলিয়ে প্রায় তিনশ’ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়া বিপন্ন ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। একইভাবে বিপন্ন অবস্থায় ১০৬ প্রজাতির নলবাহী উদ্ভিদ। জানা গেছে, দেশের অধিকাংশ নদী বর্ষাকাল শেষে মরা খালে পরিণত হয়। বিষাক্ত বর্জ্য ও নদীতে সারা বছর পানি না থাকায় মাছসহ বিভিন্ন ধরনের জলজপ্রাণীও বিলুপ্তির পথে। মিঠা পানির প্রায় ৫৪ শতাংশ প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্ত। শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপ আগের মতো দেখা যায় না।

প্রাণী বিক্রি হওয়ার অভিযোগ : নদীতে বসবাসকারী ঘড়িয়াল ও শুশুক বিলুপ্তির তালিকায় রয়েছে। গ্রামে আগের মতো দেখা যায় না গুইশাপ। অভিযোগ রয়েছে, বিলুপ্তির পথে এমন প্রজাতির বিভিন্ন প্রকার বন্য পশুপাখি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অবাধে বিক্রি হয়। রাজধানীর কাঁটাবনের পশুপাখির মার্কেট এর অন্যতম। বিরলপ্রায় সব ধরনের পশুপাখি এখানে পাওয়া যায়। লালমুখো বানর, লজ্জাবতী বানর, মুখপোড়া হনুমান, লাল ঠোঁটের টিয়া, শিকারি ঈগল, হরিণ, বন্যবিড়াল-কুকুর, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, সাপসহ অনেক প্রাণী বিক্রি হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায়ও প্রকাশ্যে গড়ে উঠেছে এমন মার্কেট, যেখানে অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে বিলুপ্ত সব প্রাণী। প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধভাবে শিকার ও বিক্রির কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে এসব প্রজাতি।

বিলুপ্তির পথে রয়েল বেঙ্গল টাইগার : বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগার এখন বিলুপ্তির পথে। প্রতিবছরই আশঙ্কাজনক হারে কমছে বাঘের সংখ্যা। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে মাত্র ১০৬টি বাঘ রয়েছে। ২০০৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। ১১ বছরেই বাঘের সংখ্যা কমেছে ৩৩৪টি। বনবিভাগের তথ্যানুযায়ী, ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত চোরা শিকারি ও বনদস্যুদের হামলা, গ্রামবাসীর পিটুনি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সুন্দরবনের প্রায় ৭০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। তাদের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৮২ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৫৩টি। ২০০৪ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৪৪০টি। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বাঘের সংখ্যা ১০৬। অন্যদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা পরিচালিত এক জরিপের তথ্যে বলা হয়, বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ৩৬৯টি। বন সংরক্ষকদের তথ্যমতে, ক্যামেরা ক্যাপচার পদ্ধতির জরিপে বাংলাদেশ এবং ভারতীয় সুন্দরবনে ৮৩ থেকে ১৩০টি বাঘের সন্ধান পাওয়া গেছে। গড় হিসেবে বাংলাদেশ অংশে প্রকৃত বাঘের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০৬।

ক্রমাগত কমছে হাতির সংখ্যা : সারা বিশ্বে এশিয়ান এলিফ্যান্টের সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ হাজার দাবি করা হলেও বাংলাদেশে এ সংখ্যা ২০০-এর বেশি হবে না। হুমকির মুখে থাকা প্রকৃতির এ বন্ধুকে গভীর সঙ্কটাপন্ন প্রাণী হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। হাতির বিচরণভূমিতে মানুষের হানা ও প্রকৃতিতে খাদ্য সঙ্কটসহ নানা কারণে হাতির সংখ্যা কমছে বলে মনে করেন হাতি বিশেষজ্ঞরা। আইইউসিএন বলছে, তিন প্রজন্মে হাতির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান হাতির দেখা মেলে। তবে কমছে সে সংখ্যা। বন উজাড় ও দাঁতের জন্য শিকারিদের উৎপাত হাতি কমার অন্যতম কারণ। হাতি শিকার ও চুরি করে পাচারও বাড়ছে দিন দিন। এভাবেই কমছে হাতির সংখ্যা। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নের ২০১২ সালের প্রকাশিত এক তথ্যমতে, ২০০৩ থেকে ২০১২ সালে ১০ বছরে মানুষের হাতে ৪৭টি হাতির মৃত্যু ঘটেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা ২০০-এর কম।

জীববৈচিত্র্যের ওপর রয়েছে যাদের প্রভাব : বন বিভাগের তথ্যমতে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ১৪টি প্রাণীর প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ডোরাকাটা হায়েনা, গ্রে উলফ (ধূসর নেকড়ে), বারাশিঙা বা কাদা হরিণ, ব্ল্যাকবাক (হরিণ জাতীয়), নীলগাই, গাওর, বানটেং (এক ধরনের বুনো মোষ), বন্য জলমহিষ, সুমাত্রান গণ্ডার, জাভান গণ্ডার, ভারতীয় গণ্ডার, দেশি ময়ূর, পিঙ্ক হেডেড ডাক (পাখি) ও মিঠা পানির কুমির। প্রাণীর প্রতি মানুষের অনুভবের স্থান সেভাবে তৈরি না হওয়ায় প্রাণী হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। প্রাণীর প্রতি মানুষের অনুভবের জায়গা সেভাবে তৈরি হয়নি। পাখি, সাপ বা ব্যাঙ দেখামাত্রই তার দিকে ঢিল ছোড়ার প্রবণতা রয়েছে। রয়েছে শিকারের মনোবৃত্তি। প্রাণীর খাবার বা আবাসস্থল কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ মানুষ। মানুষের প্রয়োজনে প্রাণী একদিকে খাবারে পরিণত হচ্ছে, অন্যদিকে হচ্ছে ভোগ-বিলাসের সামগ্রীতে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীববৈচিত্র্যের ওপর মানুষই প্রভাব ফেলছে। দেশে কৃষিজমি বৃদ্ধি করতে বন উজাড় করা হচ্ছে। মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া আবাসস্থল ও খাদ্য সংকটের কারণে কমছে নানা প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত