ঢাকা বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মিষ্টি তিক্ত শীত

হাবীবুল্লাহ সিরাজ
মিষ্টি তিক্ত শীত

শীত প্রকৃতির এক মিষ্টি আয়োজন। এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে তিক্ততার স্পর্শও। আমাদের বাংলাদেশ ষড়ঋতুর অপার বৈচিত্র্যে ভরা এক মজার দেশ। যেখানে ঋতুরও নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব ছন্দ আছে। এক ঋতু বিদায় নিলে আরেক ঋতু আসে ভিন্ন রূপে, ভিন্ন সাজে। অগ্রহায়ণের দোরগোড়ায় যখন প্রথম হিমেল হাওয়া হাত রাখে, তখনই শীতের আগমনী হিমেল বার্তা ধীরে ধীরে বাতাসে ভেসে ওঠে। আর পৌষ-মাঘের প্রান্তে এসে সে বার্তা যেন পূর্ণতা পায়। শীত তখন নিজের সমগ্র রূপ, সৌন্দর্য ও কিছুটা কঠোরতা নিয়ে প্রকৃতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

বিদায় হেমন্ত : হেমন্তের সোনালি স্নিগ্ধতা পেরিয়ে শীত যেন এক নীরব বার্ধক্যের মতো প্রকৃতির বুকে অবতরণ করে। শিশিরভেজা ঘাস, কুয়াশায় ঢাকা প্রভাত, আর দূরের বাঁশবনে লুকানো সূর্যের অবাক আলো- সব মিলিয়ে শীতকালের ভোরগুলো হয়ে ওঠে যেন প্রকৃতির কোমল ছড়া-কবিতা। বাতাসে থাকে একধরনের স্থিরতা, প্রকৃতিতে একধরনের স্থবিরতা, পরিবেশে একধরনের শুষ্কতা, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নিস্তব্ধতার মায়াবী আস্তরণ। যেন পৃথিবী একটু থেমে গিয়ে নিজের অভিমান আড়াল করতে শবনম ছড়িয়ে দিচ্ছে দিগন্তের অসীম সীমায়। তবু ঠিক এ শীত-ঋতুই সাহিত্যপ্রেমী, কবি, চিত্রকর আর প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে চিরন্তন অনুপম ভালোলাগার উৎস। শীতল আবহের ভেতরে লুকিয়ে থাকে অসংখ্য মিষ্টি শৈশব, কাঁথা মোড়ানো ভোর, গল্প, স্মৃতি ও অনুভূতির রঙ। শীতপ্রধান দেশের তুষারাবৃত সৌন্দর্য যেমন মানুষকে টানে, তেমনি আমাদের দেশের শীতও শহর-গ্রামের মানুষকে আলাদা এক প্রশান্তি উপহার দেয়। মফস্বলের কুয়াশামাখা সকাল, গাঁও-গ্রামের খেজুর রসের টুপটাপ শব্দ, খড়ের আঁটি জ্বালিয়ে আগুন পোহানো- সব মিলিয়ে শীতকাল হয়ে ওঠে এক আপন, এক স্নিগ্ধ, এক আবেগময় ঋতু।

শীত সুন্দর প্রভাত : শীতের রাত যেন একটু বেশি দীর্ঘ, একটু বেশি নিঃসঙ্গ। রাতের গভীরতা শেষ হতে না হতেই প্রভাতের আকাশে ঝুলে থাকে কুয়াশার ঘন সাদা চাদর। যেন প্রকৃতি নিজেই ক্লান্ত হয়ে উষ্ণতা খুঁজতে এক নরম কম্বল জড়িয়ে নিয়েছে। দূর থেকে সূর্যের আলো উঠতে থাকে ঢিলেঢালা। যেন সেও কুয়াশার আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। গাছপালা, পথঘাট, খোলা মাঠ- সবকিছু মিলেমিশে এক অনাবিল নীরবতা। হিমেল হাওয়ার কাঁপুনি ভেদ করে মানুষ তখন মোটা শাল বা কম্বল জড়িয়ে বের হয় প্রাত্যহিক জীবনের টানে। কুয়াশা ছেদ করে মুয়াজ্জিনের আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম ভেসে আসে। মোমিন মিষ্টি আবরণ ভেঙে বেরিয়ে পড়ে। ভোর হয়। কিন্তু এ শীতের শান্ত সকালের সৌন্দর্য অস্বীকার করার মতো নয়। শোকরে নেতিয়ে পড়ে প্রকৃতিপ্রেমিক প্রতিজন মোমিনের ভেতরাত্মা। নিঃশব্দ ভোরে মানুষ হাঁটতে হাঁটতে কুয়াশার ফোঁটায় ভেজা ধানের শীষ দেখে। গাছের পাতায় লেগে থাকা শিশিরের ঝিলিক দেখে। আর মনে মনে উপলব্ধি করে, প্রকৃতি কখনও কখনও কতটা কোমল হতে পারে! ঘর থেকে ভেসে আসে চুলার ধোঁয়া, তন্দ্রাচ্ছন্ন গ্রামজীবনের মৃদু শব্দ, আর কোথাও সরে সরে চলে যাওয়া সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি। এ সবই শীতের সকালের নিজস্ব সুর। শীতের দিনে মানুষ শুধু শৈত্য অনুভব করে না, নিজের শরীর ও জীবনের যত্নও বাড়িয়ে দেয়। ঠান্ডায় শুষ্ক ত্বক নরম রাখতে তেল বা লোশন ব্যবহার, পরিবারের সবার জন্য গরম কাপড়ের জোগাড়- এসবই শীতল দিনের একটি বিশেষ প্রস্তুতি। যেন ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনধারাও একটু বদলে যায়, একটু অধিক যত্নশীল হয়ে ওঠে।

শীতের ফুল : শীতের আগমনে প্রকৃতি যেন নিজের রঙের ডালা খুলে বসে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এক অপূর্ব রূপবৈচিত্র্য। যেখানে গাঁদা ফুলের কমলা-হলুদের উজ্জ্বলতা, ডালিয়ার রাজসিক বাহার, গোলাপের মিষ্টি সুগন্ধ আর সূর্যমুখীর সোনালি মুখ যেন শীতের কুয়াশাকে গায়ে জড়িয়ে রঙের উৎসব শুরু করে দেয়। এ ফুলগুলো শুধু বাগান নয়, শহরের রাস্তার মোড়, গ্রামের উঠোন, এমনকি প্রতিটি ফুলপ্রেমিককে করে তোলে আরও প্রাণবন্ত, আরও আকর্ষণীয়। শীতের এ ফুলের ব্যবহারে রঙিন হয় আমাদের আয়োজন-পর্বণ। উৎসব-অনুষ্ঠান, বিয়েশাদি, বাসায় অতিথি আপ্যায়ন- সবকিছুতেই শীতের ফুল যেন অপরিহার্য হয়ে ওঠে। যেন প্রকৃতিই বলে দেয়, এ ঋতু আনন্দের, রঙের এবং সৌন্দর্যকে বরণ করে নেওয়ার। ফুলের চাহিদা বাড়ে, বাড়ে মানুষের মুখের হাসিও। কারণ, ফুল তো শুধু রঙ নয়, এটি অনুভূতির ভাষা, সৌম্যতার প্রতীক, ভালোলাগার আয়োজন, ভালোবাসার পাথেয়।

শীতের সবজি : সবজিভোগী মানুষের প্রিয় ঋতু শীত। কারণ, শীতের আসল আয়োজন হলো সবজি। যখন ভোরের কুয়াশার ফোঁটা জমে থাকে ক্ষেতের পাতায়, তখন সেই সবুজ পাতার ওপর সূর্যের প্রথম আলো পড়লে মনে হয়- প্রকৃতি শিশিরমাখা মুক্তোর মালা পরে আছে। শিম, টমেটো, শালগম, ধনিয়াপাতা, গাজর, মুলা, লাউ, বরবটি- সবাই মিলে ক্ষেতজমিনে তৈরি করে এক বর্ণিল সবুজ বিস্তার। লাল শাকে মাখা ভাত কিন্তু এ ঋতুরই অনন্য উপহার। শুধু কি লালশাক? পালংশাক, মুলাশাক, কুমড়োপাতার শাক, লাউপাতার শাক। কৃষকের পরিশ্রমে সেচা এসব সবজি শুধু বাজার ভরায় না, মানুষের ঘরেও এনে দেয় তাজা স্বাস্থ্যকর খাবারের স্বাদ। নিরামেষভোগীদের আনন্দ আর ঠেকায় কে? শীতঋতুর এ সবুজ সবজির রঙিন মেলা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বন্ধনকেও আরও গভীর করে। যেন শীতের প্রতিটি সকাল বলে ওঠে- জীবন সৌন্দর্যে ভরপুর, শুধু চোখ খুলে দেখার অপেক্ষা। শোকরগোজারি বান্দা তখন বলে- এগুলো সবই আল্লাহর কারিশমা।

সবুজ মাঠে হলুদের চাদর : শীতের নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে সরিষার হলুদ মাঠ যেন আনন্দের এক উৎসব ছড়িয়ে দেয়। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, জমিনের ওপর যেন কেউ হলুদের চাদর পেতে দিয়েছে। এক বিস্তীর্ণ, মোহনীয়, প্রাণময় চাদর। অধুনা সময়ের ক্যামেরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী সরিষা হলুদ মাঠে।

সরিষা ফুলের কোমল দোল, তার ওপর ভোরের শিশিরের চিকচিক আলো, হলুদের ঘ্রাণ- সব মিলিয়ে এ দৃশ্য যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্ম। এর মাঝেই মৌমাছির ওড়াউড়ি ও গুঞ্জন শোনা যায়। তারা ফুল থেকে ফুলে উড়ে মধু সংগ্রহ করে। ক্ষেতজুড়ে সৃষ্টি হয় এক অস্বাভাবিক মিষ্টিতানের সিম্ফনি। যা শীতের সকালকে করে তোলে আরও সজীব, আরও মুগ্ধকর।

শীতপাখির কলতান : শীতঋতু শুধু ফুল-সবজি-হলুদের চাষবাসই নয়, শীত মানে বন-জঙ্গলে শিশিরভেজা হাওয়ায় শোনা যায় পাপিয়ার কলতান। থাকে নানা পাখির কূজন। কখনও দোয়েলের সুরেলা ডাক, কখনও শালিকের কোলাহল, আবার কখনও অচেনা কোনো বুনো পাখির স্বচ্ছ স্বর। এসব পাখির কলরব শুধু শীতকে নয়, পুরো প্রকৃতিকে করে তোলে অপূর্ব, জীবন্ত ও আলোড়িত। মনে হয়, প্রকৃতি যেন শীতের ঠান্ডাকে ভুলিয়ে দিতে সুরের এক নিরবচ্ছিন্ন উৎসব সাজিয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত