প্রাণের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) জগতের সেরা মানুষ। আকাশে আল্লাহ আর সৃষ্টিকুলে সমস্ত সৃষ্টি তাঁর প্রশংসা করে। তিনি চিরপ্রশংসিত। তাঁর মতো উত্তম আদর্শের মানুষ পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। তাঁর অনুপম আদর্শ ও মাধুর্যপূর্ণ আচরণে মানুষ দেখেছে নতুন পৃথিবীর ছবি। নতুন ভোরের হাসি। তাঁর সুভাসে উজালা হয়েছে সাত আসমান আর সাত জমিন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনই মানবজাতির জন্য আদর্শের প্রতীক। তাঁর জীবনের পথ মিশে গেছে জান্নাতে। আরশে আজীমে। তাঁর আলোর ঝলকে আলোকিত হয়েছে পুরো বিশ্ব- বিশ্বের সবকিছু। তাঁর সংস্পর্শে গুনাহে মত্ত যুবক হয়েছে ইতিহাসের সেরা বুজুর্গ। পরবর্তী মানুষের আদর্শের বাতিঘর। পাপের ভারে নুইয়ে পড়া বৃদ্ধা পেয়েছে প্রকৃত ও জান্নাতি জীবনের সন্ধান। অবহেলিত নারী পেয়েছে সম্মানের মসনদ।
তিনি এসে জ্বালিয়েছেন সত্যের দীপ। বিদূরিত করেছেন অন্ধকারের প্রতিষ্ঠিত স্তম্ভ। ভেঙে দিয়েছেন শ্রেণিবৈষম্য। ধনী-গরিবের পার্থক্য। উঁচু-নিচুর বিভেদ।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শের অনুসরণ করা মুমিনের জন্য ফরজ। তাঁর অনুসরণে আল্লাহকে পাওয়া যায়। আল্লাহর সান্নিধ্যে থাকা যায়। আখেরাতে শান্তির জীবনযাপন করা যায়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিকতর স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব : ২১ )।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা কলাম : ৪)।
তাঁর আদর্শের অনুসরণ, অনুকরণ ছাড়া কেউ সুখময় জীবনের সন্ধান পাবে না। জান্নাতে যেতে পারবে না। আল্লাহর সান্নিধ্য পাবে না। আল্লাহকে পাওয়ার পূর্বশর্ত হলো নবীজির পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ। আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসুল, আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা চাও তাহলে আমাকে অনুসরণ করো; তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১)।
প্রিয়নবী (সা.)-কে কীভাবে অনুসরণ করতে হবে তার জ্বলন্ত উদাহরণ সাহাবায়ে কেরাম। তাঁরা উম্মাহর শ্রেষ্ঠ মানুষ। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন সাহাবিরা। নবীজির নির্দেশনার সামনে তাদের কোনো বক্তব্য থাকত না। যেকোনো সাহাবির জীবনধারা পর্যালোচনা করলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
কোনো মানুষ তাঁর পবিত্র জীবনের অনুসরণ করলে এবং আদর্শের আলোকে জীবন সাজালে তার সাফল্য ও সৌভাগ্য নিশ্চিত। মুসলিম জাতি তাঁর পবিত্র জীবনকে ধারণ করতে পারলে কোনো মানুষ ইসলামকে ঘৃণা করতে পারবে না, ইসলামের ব্যাপারে তাদের কোনো অসন্তোষ থাকবে না। কেননা, ইসলামের প্রায়োগিক ও প্রকৃত রূপ মানবপ্রকৃতির অনুকূল। আর মানবপ্রকৃতি নিজের অনুকূল বিষয়ে শান্তি ও আত্মিক প্রশান্তি খুঁজে পায়। আল্লাহ বলেন, ‘যে রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করল, অবশ্যই সে আল্লাহর আনুগত্য করল।’ (সুরা নিসা : ৮০)।
নবীজি (সা.) উম্মতের জন্য কতটা কষ্ট সহ্যকারী, মানুষের কল্যাণে কেমন উতলা ব্যাকুল, কতটা দয়ালু, আল্লাহতায়ালা সেই কথা পবিত্র কোরআনে ব্যক্ত করেছেন এভাবে, ‘নিশ্চয় তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসুল আগমন করেছেন। যার কাছে তোমাদের কষ্ট অসহনীয়, যিনি তোমাদের (কল্যাণের) জন্য ব্যাকুল এবং তিনি মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত দয়াপরবশ ও পরম মেহেরবান।’ (সুরা তওবা : ১২৮)।
যে রাসুল (সা.)-এর ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা আপন মহামর্যাদাবান কালামে উক্ত সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তিনি যে (গোটা উম্মতের প্রতি সাধারণভাবে) এবং মুমিনদের প্রতি বিশেষভাবে কতটা দয়াপরবশ- তা তো বলাই বাহুল্য। যাকে স্বয়ং ‘রহমান-রহিম’ প্রভু অভিষিক্ত করেছেন ‘রহিম’ বা পরম দয়ালু বলে, তাঁর দয়া-মায়ার কি কোনো সীমা-পরিসীমা আছে? অক্ষম শব্দণ্ডবাক্যে কি তাঁর মায়া-মমতার পূর্ণ বর্ণনা দেয়া সম্ভব?! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
মহান আল্লাহর পরে আমাদের প্রতি যার ইহসান ও অনুগ্রহ এবং মায়া ও মমতা সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন আমাদের পরম প্রিয় নবীজি (সা.)।
বিষয়টা যতটা না বর্ণনা করার, তার চেয়ে বেশি অনুভব করার বিষয়। আল্লাহতায়ালা আমাদের দান করুন, সেই অনুভব-অনুভূতিপূর্ণ মুমিনের দিল।
আমরা এ দুনিয়ায় যা কিছু প্রকৃত খায়ের ও কল্যাণ লাভ করেছি, তা প্রিয় নবীজির মাধ্যমেই পেয়েছি। আর পরকালীন জীবনেও যদি কোনো কল্যাণ ও সফলতা অর্জিত হয়, নিশ্চয় তা তাঁর বরকতেই লাভ হবে। অতএব সংক্ষেপে শুধু বলি- ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’!
যখন আমাদের প্রতি নবীজির ইহসান ও অনুগ্রহ (মহান আল্লার পরে) সর্বাপেক্ষা বেশি, সুতরাং আমাদের ওপর তাঁর হকও সর্বাধিক। আল্লাহতায়ালা নবীজির হকগুলো আদায় করার তাওফিক আমাদের দান করুন। তাঁর প্রতি যথাযথভাবে ঈমান আনা, পরিপূর্ণ ভক্তি-ভালোবাসা পোষণ করা, তাঁর সুন্নাহ ও উত্তম আদর্শের পূর্ণ অনুসরণ করা, তাঁর জীবনী ও সিরাতের সঠিক চর্চা করা, তাঁর সুন্নতের প্রতিষ্ঠা ও প্রচার-প্রসারে সাধ্যানুযায়ী অংশগ্রহণ করা- এসব তাঁর বড় হক। এ ছাড়াও আমাদের ওপর তাঁর গুরুত্বপূর্ণ একটি হক হলো, তাঁর প্রতি অধিক পরিমাণে সালাত-সালাম প্রেরণ করা ও দুরুদ শরিফ পাঠ করা।
মুমিন জীবনের একমাত্র লক্ষ্যই হলো, আল্লাহকে পাওয়া ও জান্নাতে প্রবেশ। আর সেটার জন্য প্রয়োজন নবীজি (সা.)-এর আদর্শের অনুসরণ। নবীজির ওপর দরুদ পাঠ। তাঁর প্রতি দরুদ না পড়ে মুসলমান কখনও মুমিন হতে পারবে না। সে আল্লাহকে পাবে না। জান্নাতের মালিক হতে পারবে না। তার অন্তর পবিত্র নির্মল হবে না। ইসলামের সঙ্গে তার সম্পর্কের কোনো উন্নয়ন হবে না।
যে মুসলমানের জীবনে দুরুদ পাঠের আয়োজন নেই, যে হৃদয় মণিকোঠায় দুরুদ লালন করে না, যার মনকাবায় দুরুদের প্রেম নেই, দুরুদের জন্য যার মন হাহাকারে ভরে ওঠে না, সে মুমিন হতে পারবে না কখনও। তার নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত এবং আমল কোনো কাজে আসবে না। সুতরাং একজন মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব হলো নবীজি (সা.)-এর ওপর সবসময় দুরুদ পাঠ করা।
মহানবী (সা.)- যিনি আল্লাহর সবচে প্রিয় এবং কাছের বন্ধু। যিনি সব নবী-রাসুলদের সেরা। যার জন্য এ জগত পূর্ণতা পেয়েছে। যার জন্য অগণিত প্রাণ দেওয়ানা। যার প্রেমে মাতোয়ারা পুরো জগত। যার পায়ের কাছে প্রশ্নাতীতভাবে অনায়াসে সমর্পিত হয় অসংখ্য হৃদয়। কোরবান হয় জীবন। যার ভালোবাসায় পৃথিবী বদলে গেছে। ‘মানুষ’ প্রকৃত মানুষ হয়েছে। যার চরিত্রের পবিত্রতা স্বয়ং আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছে। সৃষ্টিজীব তাঁর বন্দনা করবে না- তা কি হয়? তাঁর নামে দুরুদ না পড়ে আত্মা কি আর পবিত্র নির্মল হতে পারে? তাই তো তাঁর নাম মনে পড়লে, কানে বাজলে শ্রদ্ধায় ভক্তিতে মাথা নুইয়ে পড়ে। হৃদয় থেকে উচ্চারিত হয়- ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’।