ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইবরাহিম (আ.)-এর বাবা হওয়ার গল্প

রায়হান রাশেদ
ইবরাহিম (আ.)-এর বাবা হওয়ার গল্প

ইবরাহিম (আ.) স্ত্রী সারা (আ.)-কে নিয়ে ফিলিস্তিনে থাকতেন সেসময়। তাদের সন্তান ছিল না। সন্তানের জন্য সারা আকুল থাকতেন। দিনমান বেচঈন থাকতেন। এদিকে ইবরাহিম (আ.)-এর আরেক স্ত্রী হাজেরার আছে ইসমাইল (আ.) নামে এক সন্তান। সারা খুব আকাঙ্ক্ষা করছিলেন, আল্লাহ তাকেও এমন পুত্রসন্তান দান করুক। স্বপ্ন দেখছিলেন, তার সন্তানও ঘর আলো করে হেঁটে বেড়াবে। আল্লাহর বাণী প্রচার করবে। মানুষকে একাত্ববাদের প্রতি আহ্বান করবে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের ওপর ক্রমশ ধুলোবালি জমতে থাকে। প্রৌঢ়ত্বের বাড়ে ধূসর হয়ে আসে ইচ্ছার রঙ। শুকিয়ে যায় প্রার্থনার প্রবাহমান নদী। ইবরাহিম (আ.)-এর বয়স তখন একশ বিশ বছর। সারা (আ.)-ও নব্বই বা বিরানব্বই বছরের পৌঢ়া। এর মধ্যে আল্লাহতায়ালা ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে কয়েকজন ফেরেশতা পাঠালেন। সন্তানের সুসংবাদ দিয়ে বৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রীকে চমকে দিলেন তারা। (তাফসিরে কুরতুবি, খণ্ড : ৯, পৃষ্ঠা : ৬২)।

ইবরাহিম (আ.) তখন মাঠে পায়চারি করছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও বেশ অতিথিপরায়ণ। তার দস্তরখান সবসময় মেহমানদের জন্য প্রশস্ত ছিল। দেখলেন, তিনজন লোক সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। চিনলেন না কাউকে। এর আগে এদের দেখেননিও কোথাও। মেহমানদারি করতে পারবেন ভেবে, বেজায় খুশি হলেন। এগিয়ে গেলেন। লোকেরা তাকে সালাম জানাল। তিনিও সালাম জানালেন। আনন্দে নিয়ে এলেন ঘরে। যত্ন করে বসালেন। তাদের আপ্যায়নের জন্য ঘর থেকে বের হলেন। তারা টেরও পেলেন না। গেলেন আস্তাবলে। তাঁর ছিল গবাদিপশুর পাল। একটি গো-বৎস জবাই করে কাবাব বানালেন। ঘিয়ে ভাজা ভুনা গোশত পেশ করলেন তাদের জন্য পাতা দস্তরখানে। (কাসাসুল কোরআন, মাওলানা হিফজুর রহমান, অনুবাদ : আবদুস সাত্তার আইনী, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৭০)।

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আমার প্রেরিত ফেরেশতারা ইবরাহিমের কাছে সুসংবাদ নিয়ে এসেছিল। তারা এসে বলল, ‘তোমার প্রতি সালাম! সেও বলল, ‘তোমাদের প্রতিও সালাম!’ অনতিবিলম্বে সে ভুনা করা বাছুর নিয়ে এলো।’ (সুরা হুদ : ৬৯)।

তারা খাবার ছুঁয়েও দেখলেন না। ফেরেশতারা তো আর খাবার খায় না। তারা পানাহারের ঊর্ধ্বে। কিন্তু ব্যাপারটি ইবরাহিম জানতেন না। তিনি তাদের খেতে বললেন। তারপরও ফেরেশতারা খাবার খাওয়া থেকে বিরত রইলেন।

তিনি ভয় পেয়ে বসলেন। ভাবলেন, তাদের মনে হয়তো দুরভিসন্ধি আছে। সেকালে কোনো শত্রু কারও বাড়িতে গেলে বাড়িওয়ালার কোনো কিছু খেত না। কারণ, কারও বাড়িতে গিয়ে তার কিছু খেয়ে তার সঙ্গে শত্রুতা করা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পরিপন্থি মনে করা হতো। ফেরেশতারা তাঁকে অভয় দিলেন। নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমরা আপনাকে একটি সুসংবাদ দিতে ও একটি বিশেষ কাজ করতে এসেছি।’ (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ : মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, পৃষ্ঠা : ৬৩৭)।

নুহ ইবনে কায়স (রহ.) বলেন, নুহ ইবনে আবু শাদ্দাদের মতে, ইবরাহিম (আ.) মেহমানদের সামনে ভুনা করা গো-বৎস উপস্থিত করার পর জিবরাইল (আ.) তার ডানা দিয়ে গা মুছে দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা জীবিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায় এবং তার মায়ের কাছে চলে যায়। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ২৬৬)।

ফেরেশতারা ইবরাহিম (আ.)-কে এক জ্ঞানী পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দিলেন। এই ছেলের এক ছেলে হবে সে কথাও জানালেন। ছেলের নাম হবে ইসহাক আর ইসহাকের ছেলের নাম ইয়াকুব। সারা আড়াল থেকে এসব কথা শুনছিলেন। তিনি বেশ আশ্চর্য হলেন। এই বৃদ্ধ বয়সে সন্তান! তিনি গাল চাপড়িয়ে উচ্চঃস্বরে হেসে হেসে বললেন, ‘এই বয়সে তবে সন্তান হবে আমার! আমি তো একবারে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছি। আমি তো বন্ধ্যা। যৌবনেও আমি সন্তান ধারণের যোগ্য ছিলাম না।

আমার স্বামী তো বৃদ্ধ। তারও বয়স হয়েছে যথেষ্ট। চুল কাশফুলের মতো শুভ্র হয়ে গেছে। বয়সের বাড়ে নুব্জ হয়ে গেছে পিঠ।’ এমন ঘটনা সে সমাজে নেই। এমন বয়সে কারই-বা সন্তান হয়েছে তখন। চোখে পড়েনি তাদের। এমন কথাও শুনেনি কারও মুখে। তবুও যদি তার কোল আলো করে পুত্রসন্তান আসে। আজীবন লালিত কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন যদি পূরণ হয়, তাহলে সারার চেয়ে এই পৃথিবীতে খুশি আর কে হবে? চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক নিয়ে সারা তাদের সঙ্গে মধুর বাকবিতণ্ডা শুরু করে। শক্ত ইটের দেয়ালের মতো নিজেদের বয়সের যুক্তি দাঁড় করায়। ফেরেশতারা তাকে আল্লাহর নিদর্শনের কথা বলেন। আল্লাহর হুকুমের কথা বলেন। তিনি আনন্দে আহ্লাদে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, মাওলানা মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলভি, অনুবাদ : মুফতি মুহাম্মাদ আবদুল হালীম, খণ্ড : ৭, পৃষ্ঠা : ৫৭৮)।

পবিত্র কোরআনে এ ঘটনা বাঙময় হয়েছে এভাবে- ‘(ইবরাহিমের) স্ত্রী দাঁড়িয়েছিল, সে হেসে ফেলল। তখন আমি তাকে ইসহাকের আর ইসহাকের পর ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম। সে বলল, ‘হায় আমার কপাল! সন্তান হবে আমার, আমি তো অতি বুড়ি আর আমার এই স্বামীও বৃদ্ধ, এতো এক আশ্চর্য ব্যাপার।’ তারা বলল, ‘আল্লাহর কাজে তুমি আশ্চর্য হচ্ছ, ওহে (ইবরাহিমের) পরিবারবর্গ! তোমাদের ওপর রয়েছে আল্লাহর দয়া ও বরকতগুলো, তিনি বড়ই প্রশংসিত, বড়ই মহান।’ (সুরা হুদ : ৭১-৭৩)। কোরআনের আরেক জায়গায় আছে, ‘তারা বলল, ভয় করো না, আমরা তোমাকে এক জ্ঞানী পুত্রের সংবাদ দিচ্ছি। সে বলল, তোমরা কি আমাকে (পুত্রের) শুভ সংবাদ দিচ্ছো আমি বার্ধক্যগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও? তোমরা কী বিষয়ে শুভ সংবাদ দিচ্ছো? তারা বললো, আমরা সত্য সংবাদ দিচ্ছি; সুতরাং তুমি হতাশ হও না। সে বলল, যারা পথভ্রষ্ট তারা ছাড়া আর কে তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ থেকে হতাশ হয়?’ (সুরা হিজর : ৫১-৫৬)।

তাওরাতে এই ঘটনার বিবরণ রয়েছে এভাবে- ‘আল্লাহ ইবরাহিমকে বললেন, তোমার স্ত্রীকে আর ‘সারি’ বলো না; বরং তার নাম সারাহ। আমি তাকে বরকত দেব। সে অনেক সম্প্রদায়ের মা হবে এবং বহু রাজ্যের রাজা তার বংশে জন্ম নেবে।

ইবরাহিম মাথা নিচু করে হেসে হেসে মনে মনে ভাবলেন, একশো বছর বয়স্ক বৃদ্ধের পুত্র জন্মগ্রহণ করবে আর নব্বই বছর বয়স্কা সারাহ পুত্র সন্তান প্রসব করবে? ইবরাহিম আল্লাহর কাছে আরজ করলেন, আমার ইসমাইলকে ভালো রেখো আল্লাহ। আমি এতেই খুশি।। আল্লাহ বললেন, নিঃসন্দেহে তোমার স্ত্রী সারাহ তোমার জন্য পুত্র প্রসব করবে, তার নাম রেখো ইসহাক।’ (তাওরাত, অনুচ্ছেদ : ২০ : ১৫-১৯)।

ইবরাহিম (আ.) ফেরেশতাদের দ্বিতীয় কাজ সম্পর্কে জানতে পারলেন, তারা লুত (আ.)-এর সমকামী জাতিকে ধ্বংস করতে এসেছেন। তাদের কাছে লুত ও ঈমানদারদের ব্যাপারটি নিয়ে তর্কজুড়ে দিলেন তিনি। তারা জানালেন, তাদের কিছু হবে না। তারা নিরাপদ থাকবে। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যখন ইবরাহিমের আতঙ্ক দূর হলো এবং তিনি সুসংবাদপ্রাপ্ত হলেন, তখন তিনি আমার সঙ্গে তর্ক শুরু করলেন কওমে লুতের ব্যাপারে।’ (সুরা হুদ : ৭৫)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত