প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
কাহিনি চলছিল এক রুগ্ণ ব্যক্তির চিকিৎসা নিয়ে। মানসিক রোগী দেখে ডাক্তার তার ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিল তোমার মন যা চায় তাই করবে। এটিই তোমার চিকিৎসা। এমন ব্যবস্থাপত্রে আনন্দিত রুগ্ণ লোকটি একদিন পুকুরের ঘাঁটে দেখে একজন সুফি অজু নিয়ে ব্যস্ত। তার মন চাইল সুফির ঘাড়ে কষে একটি চড় দিতে। যেই চিন্তা সেই কাজ। চড় খেয়ে সুফি চমকে উঠে চাইল পাল্টা একটি ঘুষি রুগ্ণ লোকটির গর্দানে বসিয়ে দিতে।
গল্পের ধারাভাষ্যে বিরতি দিয়ে মওলানা রুমি (রহ.) মাঝখানে আরেকটি কাহিনির অবতারণা করেন। কাহিনির চরিত্রে আছেন সুলতান মাহমুদ গজনভী ও এক হিন্দি বালক। এই কাহিনিতে মওলানা ফকিরি জীবন অর্থাৎ আল্লাহমুখী অনাড়ম্বর জীবনের অতুলনীয় রহস্য করেন, এসব রহস্যের কিছু ঝলক আমরা গত কিস্তিতে পেয়েছি। মওলানার কথা হরো, ফকিরি জীবনের রহস্য, আল্লাহর জন্য ফানা হয়ে যাওয়ার মাকাম সম্পর্কে আমি বেশ কিছু কথা বলেছি। এসব কথা তুমি বোঝার চেষ্টা কর, যদি বুঝে না আসে, তোমার চিন্তাশক্তি যদি তামাদি হয়ে যায়, যদি চিন্তার জট না খোলে তাহলে ফিকির (চিন্তা) বাদ দিয়ে জিকিরে চল। কারণ, তোমার জিকির বন্ধ থাকার ফলে নফসানি কামনা-বাসনা তোমার কলবকে আচ্ছন্ন, জমাটবদ্ধ করেছে। জিকিরের উত্তাপ ছড়াও কলবের জমাট বরফ গলে যাবে, চিন্তার জট খুলে যাবে। জিকিরের আলোর বিচ্ছুরণে তোমার কলব আলোয় উদ্ভাসিত হবে।
জিকর আরদ ফিকর রা দর এহতেজাজ
জিকর রা খোরশিদে ইন আফসারদা সাজ
জিকির আনে চিন্তায় গতি কর্মমুখর করে জীবন
জিকিরকে কর জমাট চিন্তার ওপর সূর্যের বিকিরণ।
আল্লাহর জিকির মনের জড়তা, কলবের অলসতা ও চিন্তার জমাটবদ্ধতার দূর করে কর্মে আনে গতিময়তা। কাজেই জিকিরকে তুমি সূর্যের ভূমিকায় রাখ। তাহলে জিকিরের আলোকরশ্মির বিকিরণে কলবের জমাটবদ্ধ বরফ গলে যাবে। জিকির মানে সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ। তবে সাধনার পথে আসল কথা হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে আকর্ষণ। এই আকর্ষণ হলেই তোমার কলব জাগ্রত হবে। জড়তা আড়ষ্টতা দূর হবে। কিন্তু সাবধান-
আস্ল খোদ জজ্ব আস্ত লেক আই খাজাতাশ
কার কুন মওকুফে আন জজবা মবাশ
আসল হলো আকর্ষণ ওদিক হতে বুঝ হে সুজন
কাজ করে যাও, বসে থেকো না কবে আসবে আকর্ষণ।
ওহে সাধক, সাধনার পথে আসল বিষয় হলো দাওয়াত পাওয়া। ওদিকের আকর্ষণ আসলেই তোমার পথ খুলে যাবে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি কাজ করে যাও, চেষ্টা চালিয়ে যাও। ওদিকের আকর্ষণ কবে আসবে সে আশায় বসে থেকো না। হঠাৎ আল্লাহর পক্ষে আকর্ষণ এসে কামালিয়াতের শীর্ষে পৌঁছে দেবে- এমন আশা নিয়ে ইবাদত বন্দেগি সৎকর্ম সাধনা ত্যাগ করে বসে থাকলে বোকামি হবে। তুমি হয়তো চিন্তা করছ, আমি তাকে ভালোবাসি। ভালোবাসার আকর্ষণে তিনি আমাকে তার সান্নিধ্যে নিযে যাবেন। কিন্তু সত্য কথা হলো, ভালোবাসার দাবি তো বন্ধুর জন্য ত্যাগ স্বীকার করা। তোমাকে ত্যাগ স্বীকার করেই ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে। অকর্মণ্য বসে বসে অভিমান করলে পাছে ভীষণ পস্তাতে হবে। কাজেই এসব চিন্তা বাদ দিয়ে তুমি একটি কাজ করো,
ন কবুল আন্দিশ না রদ আই গোলাম
আমর রা ও নাহয় রা মি বিন মোদাম
কবুল হলো কি বাতিল হলো তা নিয়ে চিন্তা ছাড়
তার আদেশ ও নিষেধ কিসে দেখে দেখে পথ চল।
তাহলে দেখবে হঠাৎ ওপরের আকর্ষণ তোমাকে তার ভালোবাসার শিকলে আবদ্ধ করে ফেলেছে। সাধারণ্যে বোধগম্য কয়েকটি বিষয় এখানে ব্যক্ত করা হলো। বিস্তারিত জানার জন্যে মসনবি শরিফের ৬ষ্ঠ খণ্ড অনুবাদ ও ব্যাখ্যা পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর গুণতে হবে।
বস্তুত অগণিত তত্ত্বকথার পর মওলানা রুমি (রহ.) আসল গল্পের ধারাভাষ্যে এসে বলছেন, সুফির ঘাড়ে চড় দেওয়া রুগ্ণব্যক্তির কী হলো। সুফি চাইল একটি আস্ত ঘুষি দিয়ে জবাব দিই রুগ্ণ লোকটির ঘাড়ে। পরক্ষণে চিন্তা করে, এই লোক তো এমনিতে মরে যাবে। আমার ঘুষির ধকল সওযার শক্তি তো তার শরীরে নেই। আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে সে ধরাশায়ী হবে, প্রাণ ত্যাগ করবে। পরে আমার বিরুদ্ধে খুনের মামলা হবে। মরা মানুষ মেরে কিসাস দিতে আমাকে নিহত হতে হবে, তা হতে পারে না। কাজেই ভালো হয় তাকে কাজির আদালতে নিয়ে যাই।
হাস্ত কাজি রহমত ও দফএ সেতিজ
কাতরেঈ আজ বাহরে আদলে রাস্তাখিজ
বিরোধ দমনে বিচারক আল্লাহর রহমত স্বরূপ
পরকালের ন্যায়বিচারের সাগরের তা বারিবিন্দু।
ন্যায় বিচারক কাজির বিচার-ফয়সালার মধ্য দিয়ে আল্লাহর রহমতের প্রকাশ ঘটে। ঝগড়া বিরোধের অবসান হয়। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে কাজির ফয়সালা শেষ বিচারদিনের ন্যায়বিচারের সাগরের এক ফোটা পানির সঙ্গে তুল্য। সাগরের পানির কণা যদিও সাগর নয়; কিন্তু তুমি সেই কণার মধ্যে আছে সাগরের পানির স্বচ্ছতা। সেই বারিবিন্দুর আয়নায় তুমি দেখতে পার সাগরের বিশালতা।
মওলানা রুমি আধ্যাত্মিক তত্ত্বরহস্যের বর্ণনায় বিরতি টেনে বলেন, সুফি রুগ্ণ ব্যক্তিকে শক্ত হাতে ধরে বলল, আমি তোমাকে মারব না, তবে কাজির দরবারে যেতে হবে। তোমার প্রাপ্য শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে। তুমি মনে করো না, অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে। অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্য প্রত্যেককে অবশ্যই ভুগতে হবে।
সুফি মামলা দায়ের করলেন কাজির আদালতে। জীর্ণশীর্ণ রুগ্ণ ব্যক্তিটি এই মামলার বিবাদি। মামলার আর্জি শুনে কাজি বললেন, নালিশ আমলে নিতে হলে অভিযোগের পক্ষে স্বাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করতে হবে। সাক্ষী নেই তো বিবাদিকে জীবন্ত হাজির করতে হবে। আপনি যাকে ধরে নিয়ে এসেছেন সে তো কোনো জীবন্ত লোক নয়, জীর্ণশীর্ণ কংকালসার। মরা মানুষের সঙ্গে এর পার্থক্য নেই। সুফি প্রতিবাদ করে, কাজি, এই লোকটাই তো আমার গর্দানে আচমকা চড় দেয়। সে কী নির্দোষ খালাস পেতে পারে? কাজি হেসে বললেন, আগে শুনি আপনার কাছে কী আছে বলুন। ছয়টি দাঙ্গ আছে, সুফি বললেন। এগুলোই আমার সম্বল। আপনি সুফি মানুষ। আপনার অর্ধেক টাকা তিন দাঙ্গ দিয়ে দেন এই রুগ্ণ। বেচারা না খেয়ে মরে যাবে।
সুফি প্রতিবাদ করেন, তা হতে পারে না। এমন রায় পরিষ্কার জুলুম। বিচারক বুঝিয়ে বললেন, আদলতের বিচার তো ধনী লোকদের অন্যায় দমনের জন্য। বিচারের শাস্তি প্রয়োগ করা যায় জীবন্ত লোকদের ওপর। এই লোক তো না ধনী, আর না জীবিত প্রাণী, বেঁচে থেকেও জীবনমৃত। এর কী বিচার করব বা শাস্তি দেব। লোকটির প্রতি উদারতা দেখানোই হবে মহানুভবতা। সুফি বললেন, অন্যায়কারীকে পুরষ্কৃত করা, জালিমকে প্রশ্রয় দেওয়ার পরিণাম কিন্তু কাউকে ছাড়ে না। আপনার এই বিচার আমি মানতে পারি না।
সুফি আর কাজির বাদানুবাদ চলছে। এরই মধ্যে রুগ্ণ ব্যক্তির মনে খায়েশ জাগল, কাজির ঘাড় তো আরও প্রশস্ত, যদি তার কান বরাবর কষে একটা চড় বসিয়ে দিই, কেমন হয়। জরিমানা তো তিন পয়সার বেশি আসবে না। ডাক্তার তো বলেছেন, আমাকে সুস্থ হতে হলে আমার মন যা চায় তাই করতে হবে। যেই চিন্তা সেই কাজ। ধীর পদে সামনে এগিয়ে রুগ্ণ কষে একটি থাপ্পড় দিল কাজির গর্দান জুড়ে। বলল, ছয় দাঙ আমার লাগবে না। তোমরা দুজনে ভাগ করে নাও।
ব্যভাচেকা খেয়ে কাজি এখন ভীষণ ক্রদ্ধ। সুফি তার সুযোগ নিলেন। কাজি! অন্যের জন্য গাঁড়া খুঁড়লে সে গাঁড়ায় নিজেকেই পড়তে হয়। হাদিসের বাণী কি পড়েননি, ‘যে নিজের ভাইয়ের জন্য কূপ খনন করে সেই কূপে সে নিজেই পতিত হয়।’ অন্যায়কারীর প্রতি দয়া দেখানো মানে নেকড়ের ছানাকে ছাগল দুধ খাওয়ানো। অন্যায় বিচার করে মনে করেছিলেন, পার পেয়ে যাবেন। আল্লাহরই ফায়সালা, এই চপেটাঘাত আপনার প্রাপ্য ছিল, আপনার কপালের লিখন।
কাজি যেন হুঁশজ্ঞান ফিরে পেলেন। তার আত্মণ্ডউপলব্ধি হলো, হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি। এটিই আমার কপালে লেখা ছিল। অন্যায় করেছি, বদলা পেয়েছি। তাতে আমি রাজি আছি। আমার চেহারায় রাগের ছাপ আছে, তবে ভেতরে আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্টির সয়লাব। এ মুহূর্তে আমার অন্তরের অবস্থা বাগানের মতো আর চেহারা, চোখ মুখ মেঘলা আকাশ। রৌদ্রের তাপদাহে দগ্ধ জমিতে মেঘমালার বরিষণ চাই। সেই বরিষণ চোখের পানি। নিজের কৃতকর্মের জন্য কাঁদলে সুজলা সুফলা হবে দিলের জমি। কোরআনে তাই বলা হয়েছে, তারা যেন বেশি বেশি কাঁদে আর কম হাসে। (সুরা তাওবা : ৮২)।
কান্নার উপমা মোমবাতি জ্বলে গলে যাওয়ার মতো। তোমার মনের উত্তাপ যদি চোখ দিয়ে গলিত মোম হয়ে বেরিয়ে আসে, তাহলে তোমার জীবন আলোকিত হবে। কান্না দুঃখের নিদর্শন। তোমার মনকে কান্নার জন্য তৈরি করতে চাও, এমন কারও সান্নিধ্য চাও, যে আল্লাহর ভয়ে কাঁদে। তার সন্ধানে বন্ধুদের মাঝে বিচরণ করো। বন্ধুদের মহলে নিজেকে জাহির করতে যেও না। অন্যের কথা কান পেতে শুনো। মনে রেখ, যারা জাগ্রত তারা অন্যের কথা শুনে। নিদ্রিত বা মৃতরাই অন্যের কথা শোনে না। কাজেই তুমি জাগ্রত জীবন্ত মানুষ হওয়ার চেষ্টা কর। বন্ধুদের মজলিসে নীরব-শ্রোতা হওয়ার সাধনা করো, অভ্যাস গড়ে তোলো। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : বয়েত : ১৪৬৬-১৬০০)।
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)