ঢাকা রোববার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ৬ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ডেঙ্গু-চিকনগুনিয়াবাহী মশা নিয়ন্ত্রণে গবেষণা প্রয়োজন: চসিক মেয়র

ডেঙ্গু-চিকনগুনিয়াবাহী মশা নিয়ন্ত্রণে গবেষণা প্রয়োজন: চসিক মেয়র

ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়াবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে টেকসই ও কার্যকর সমাধান নিশ্চিত করতে গবেষণাভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।

রোববার (২১ ডিসেম্বর) থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামে আয়োজিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এআরএফ)-এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত “চট্টগ্রামে ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের সার্বিক পরিস্থিতি, জনস্বাস্থ্যে প্রভাব, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ভাইরাসের জিনোমের স্বরূপ উন্মোচন” শীর্ষক একটি বিস্তৃত গবেষণা কার্যক্রমের ফলাফল উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন।

মেয়র বলেন, নগর এলাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, এটি একটি বড় জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ। মশার প্রজননস্থল, মৌসুমি ও জলবায়ুগত প্রভাব, নগরের অবকাঠামো এবং মানুষের আচরণ—এসব বিষয় বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ না করলে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদে সফল হবে না।

তিনি গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণ, ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দেন।

এসময় তিনি গবেষক, চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ামুক্ত নগর হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র নিরূপণ এবং ভবিষ্যৎ জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর কৌশল প্রণয়নের লক্ষ্যে চলতি বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই গবেষণা পরিচালিত হয়।

এসপেরিয়া হেলথ কেয়ার লিমিটেডের সহযোগিতায় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, ইউএসটিসি, এপোলো ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল, ডিজিজ বায়োলজি এন্ড মলিকুলার এপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ এবং নেক্সট জেনারেশন রিসার্চ, সিকুয়েন্সিং এন্ড ইনোভেশন ল্যাব চিটাগং (এনরিচ)-এর গবেষকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই গবেষণায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও বিভিন্ন উপজেলার রোগীদের ক্লিনিক্যাল, জনস্বাস্থ্য, রোগতত্ত্ব এবং জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের ওপর বিস্তারিত ও বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ করা হয়।

চিকুনগুনিয়া সংক্রান্ত গবেষণায় গবেষকরা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে চিকুনগুনিয়া বর্তমানে দ্রুত বিস্তারমান একটি মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ হিসেবে গুরুতর জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জে রূপ নিয়েছে।

গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, এই রোগ কেবল স্বল্পমেয়াদি জ্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং দীর্ঘস্থায়ী অস্থিসন্ধির ব্যথা, কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে।

গবেষণায় আরও উঠে আসে যে, চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে ডেঙ্গু (১০ শতাংশ) ও জিকা (১ দশমিক ১ শতাংশ) একযোগে সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে কোতোয়ালী, বাকলিয়া, ডবলমুরিং, আগ্রাবাদ, চকবাজার, হালিশহর ও পাঁচলাইশ এলাকায় সংক্রমণের হার ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। উপজেলা পর্যায়ে সীতাকুণ্ড, বোয়ালখালি ও আনোয়ারা এলাকায় সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়।

অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী অস্থিসন্ধির ব্যথা তিন মাসের বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয়েছে, যার হার প্রায় ৬০ শতাংশ। ভুল রোগ নির্ণয় ও পর্যাপ্ত রিপোর্টিংয়ের অভাবে প্রকৃত রোগভার অনেকাংশেই অজানা থেকে যাচ্ছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।

পাশাপাশি জনসচেতনতার অভাব এবং গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ রোগ ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করে তুলছে।

চট্টগ্রামে এক হাজার একশত রোগীর ওপর পরিচালিত দেশের বৃহত্তম এই গবেষণায় দেখা গেছে, গোড়ালি, হাঁটু, কব্জি ও হাতের অস্থিসন্ধি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। বহু রোগীর ক্ষেত্রে সকালে অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে যাওয়া ও ফোলা ভাবের লক্ষণ স্পষ্টভাবে পাওয়া গেছে।

জিনগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভাইরাসের উল্লেখযোগ্য জিনগত বৈচিত্র্য শনাক্ত করা হয়েছে, যেখানে দেখা যায় এই ভেরিয়েন্ট পূর্বে পাকিস্তান, ভারত ও থাইল্যান্ডে শনাক্ত হওয়া ভেরিয়েন্টের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও চট্টগ্রামে প্রাপ্ত ভাইরাসে অর্ধশতাধিক জিনগত পরিবর্তন বা মিউটেশন বিদ্যমান রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আরও গভীর গবেষণা চলমান রয়েছে।

গবেষকরা মত দেন যে, চিকুনগুনিয়া এখন আর কেবল একটি সাময়িক জ্বরের রোগ নয়; এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র ডেঙ্গুকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল দিয়ে এই রোগ মোকাবিলা সম্ভব নয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।

অন্যদিকে, ডেঙ্গু সংক্রান্ত গবেষণায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের মোট এক হাজার সাতশত সাতানব্বই জন রোগীর ক্লিনিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।

এতে দেখা যায়, প্রায় অর্ধেক রোগী সতর্কতামূলক লক্ষণসহ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিলেন এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী গুরুতর ডেঙ্গুতে ভুগেছেন। উপসর্গ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় সব রোগীরই জ্বর ছিল। পাশাপাশি বমিভাব, মাথাব্যথা, মাংসপেশির ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পেটব্যথা ও ডায়রিয়ার মতো উপসর্গ উচ্চ হারে উপস্থিত ছিল।

জনসংখ্যাগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠী ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে এবং পুরুষ রোগীর সংখ্যা নারীদের তুলনায় বেশি। শহরাঞ্চলের মানুষ গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে বলেও গবেষণায় উঠে আসে। সহ-রোগ বিশ্লেষণে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া গেছে। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ ও শরীরে তরল জমে যাওয়ার মতো জটিলতাও শনাক্ত করা হয়েছে।

সার্বিকভাবে গবেষণায় বলা হয়, চট্টগ্রামে ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রধানত তরুণ, শহরাঞ্চলের পুরুষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগটি নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে থাকলেও সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি।

উক্ত গবেষণায় নেতৃত্ব প্রদান করেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আবুল ফয়সাল মোহাম্মদ নুরুদ্দিন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আদনান মান্নান। গবেষক দলে আরও যুক্ত ছিলেন দেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা চিকিৎসক ও গবেষকগণ।

গবেষণা কার্যক্রমে সহযোগিতায় ছিল বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যাপক ও প্রিন্সিপাল ডা. জসিম উদ্দিন, মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ সাত্তার, হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইবরাহিম চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. একরাম হোসাইন।

এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এসপেরিয়া হেলথ কেয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান গোলাম বাকি মাসুদসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চিকিৎসক ও গবেষকবৃন্দ।

রিসার্চ প্রজেক্টের টিম লিডার অধ্যাপক ডা. আদনান মান্নান বলেন, “ভাইরাসের জিনগত বিশ্লেষণে আমরা একাধিক নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশন শনাক্ত করেছি, যা এই অঞ্চলে রোগের বিস্তার ও তীব্রতার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। এসব তথ্য ভবিষ্যতে চিকিৎসা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ কৌশল নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

এসপেরিয়া হেলথ কেয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান গোলাম বাকি মাসুদ বলেন, “ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এখন কেবল চিকিৎসা-সংক্রান্ত সমস্যা নয়; এটি একটি সমন্বিত জনস্বাস্থ্য ও উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ। গবেষণাভিত্তিক তথ্য ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। এসপেরিয়া সবসময় বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও জনস্বার্থে কার্যকর উদ্যোগের পাশে রয়েছে।”

গবেষণার নেতৃত্বদানকারী চিকিৎসকরা জানান, শুধুমাত্র ডেঙ্গুকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। চিকুনগুনিয়াকে একটি দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত রোগ নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার ওপর তারা গুরুত্বারোপ করেন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক-গবেষকরা এই গবেষণাকে চট্টগ্রাম ও দেশের জন্য একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং গবেষণার ফলাফলকে জনস্বাস্থ্য নীতিনির্ধারণে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান।

চসিক মেয়র,মশা নিয়ন্ত্রণে গবেষণা,ডেঙ্গু-চিকনগুনিয়া
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত