
বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ুজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষকে পুনর্বাসনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) সকালে চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) এবং ইংরেজি পত্রিকা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের যৌথ উদ্যোগে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত পরিবার ও শিশুরা’ (‘Climate Action Induced families and children engaged in hazardous jobs’) শীর্ষক গোল টেবিল বৈঠকটির আয়োজন করা হয়।
সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে চট্টগ্রামে আসছেন। তাদের শিশুরা আসছেন। নগরীর বিভিন্ন ফুটপাতে দেখছি ওইসব পরিবারদের। এই শিশু একসময় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এই সমস্যার মূলে যেতে হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উন্নত দেশগুলো থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যাচ্ছে না কেন— এর দিকে নজর দিতে হবে। হয়তো আমরা সঠিকভাবে অ্যাডভোকেসি করতে পারছি না, আর যদি অ্যাডভোকেসি করে অর্থায়ণ আনা হয়, তাহলে সেটি নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে।
মেয়র বলেন, “চট্টগ্রামে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা মানুষদের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ আছেন। যেখানে তারা দুর্যোগের শিকার হয়েছেন, সেখানেই তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। তাহলে শহরের লোড কমবে। চট্টগ্রাম নগরীতে ৬০ লাখ মানুষ বসবাস করেন। আরো ১০ লাখ মানুষের লোড নেওয়া ক্ষমতা এই শহরের নেই।”
নগর সরকার বাস্তবায়ন ছাড়া পরিকল্পিত নগরায়ণ সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, নগরীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো একেকটি একেক মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তারা সিটি করপোরেশনের কথা শুনতে বাধ্য নয়। সমন্বিত কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা ছাড়া পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এজন্য আমি দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন থেকে নগর সরকারের কথা বলে আসছি। লন্ডন, টরেন্টোসহ বিশ্বের অনেক শহর নগর সরকার ব্যবস্থা আছে।
ইপসার প্রধান নির্বাহী মো. আরিফুর রহমানের সভাপতিত্বে ও দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান সামছুদ্দিন ইলিয়াসের সঞ্চালনায় গোল টেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মো. শামসুদ্দোহা, চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমএম নুরুল আবসার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আল-আমীন, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মাহবুবুল হাসান, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জুলিয়া পারভীন, জেলা শিশু কর্মকর্তা মোসলেহ উদ্দিন, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ওমর কায়সার, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান, ব্র্যাক চট্টগ্রামের ম্যানেজার মো. নজরুল ইসলাম, উন্নয়ন সংস্থা ঘাসফুলের প্রতিনিধি সাদিয়া রহমান, এসডিজি ইয়ুথ ফোরামের প্রতিনিধি নোমান উল্লাহ বাহার, ওয়ার্ল্ড ভিশনের প্রতিনিধি রিপা চাকমা, ক্লাইমেট অ্যাকটিভিস্ট খাদিজা আক্তার মাহিমা প্রমুখ।
গোল টেবিল বৈঠক কি-নোট উপস্থাপন করেন ইপসার হেড অব অ্যাডভোকেসি মুহাম্মদ আলী শাহীন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু দুর্যোগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ১০টি দেশের একটি। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙনের কারণে প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব পরিবার শহরমুখী হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনানুষ্ঠানিক কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে, যেখানে শিশুশ্রম ভয়াবহভাবে বাড়ছে। জলবায়ু-বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী ঘরবাড়ি, জমি ও ফসল হারাচ্ছে; কৃষিভিত্তিক আয় ভেঙে পড়ছে; সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে এবং মানসিক চাপ বাড়ছে। বাস্তুচ্যুত পরিবারের ৭৫ শতাংশের আয় অভিবাসনের পর ৫০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। চট্টগ্রামে ৬০ শতাংশের বেশি জলবায়ু অভিবাসী অনানুষ্ঠানিক বস্তিতে বসবাস করছে, যেখানে মৌলিক সেবার ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশে মোট শিশু (৫–১৭ বছর) প্রায় ৪ কোটি। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু শ্রমে নিয়োজিত এবং ১০–১২ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত। গত এক দশকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমিক বেড়েছে প্রায় ২ লাখ। উপকূলীয় বস্তিতে ১০–১৭ বছর বয়সী ১৮ শতাংশ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত। ড্রাই ফিশ সেক্টরে মোট শ্রমিকের প্রায় ২০ শতাংশ শিশু (এর ৭৪ শতাংশ মেয়ে) এবং মেটাল ফ্যাক্টরি সেক্টরে অধিকাংশ শিশু শ্রমিক ছেলে (প্রায় ৮০ শতাংশ)। এসব শিশুর ৭৫ শতাংশ স্কুলের বাইরে, যা জলবায়ু বাস্তুচ্যুতি ও জীবিকা হারানোর সরাসরি পরিণতি এবং দেশের ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকি।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মো. শামসুদ্দোহা বলেন, ২০০৫ সালে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান অ্যাকশন এবং পরবর্তীতে ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যানে সেকেন্ডারি ও টার্সিয়ারি লেভেল যুক্ত ছিল না। ওই প্ল্যানে নারী, শিশু, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে আমলে নেওয়া হয়নি। পরিকল্পনাগুলো মানুষকে কেন্দ্র করে নেওয়া হয়নি। সবসময় অবকাঠামো, প্রকিউরমেন্ট, উন্নয়ন ছিল পরিকল্পনাগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে। এগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষ রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের শিশু যখন তার বিকাশ নষ্ট করছেন, তখন সেটি ইন্টার জেনারেশন লসে পরিণত হয়। পরবর্তী প্রজন্মের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের এক্সটেন্ডেড ইমপ্যাক্ট অ্যাড্রেস করতে হবে।
তিনি বলেন, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য স্যাটেলাইট সিটি করতে হবে। যেন শহরের আশপাশের উপশহর থেকে এসে কাজ করে আবার ফিরে যেতে পারে। তাহলে শহরের ওপর চাপ কমবে। শিশু কেন্দ্রিীয় ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন প্ল্যান হাতে নিতে হবে। শুধু জিডিপি বা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে নয় মানুষের জীবনমানকে প্রাধান্য দিতে হবে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মাহবুবুল হাসান বলেন, আমরা সারাদেশে হিসেব না করে শুধু চট্টগ্রামকে নিয়ে প্ল্যান করতে চাই। চট্টগ্রামে অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলো কোটি কোটি টাকা সিএসআর ফান্ড রয়েছে। যদি এই ফান্ডগুলোকে নিয়ে যতোপযুক্ত ব্যবহার করতে পারি, তাহলে এই সমস্যা অনেক দূর কমে আসবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো, আল-আমীন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের পরিবর্তনের ফলে ড্রপ আউট শিশুদের আবারও ফিরিয়ে আনত হবে। ছেলে মেয়েদের সচেতনতা তৈরি করতে হবে। আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশু বের করতে আনতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।