ঢাকা শনিবার, ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হালাল উপার্জন কেন জরুরি

হালাল উপার্জন কেন জরুরি

যে কোনো বস্তু হালাল বা পবিত্র হওয়ার জন্য দুটি শর্ত রয়েছে- প্রথমত ব্যবহার্য, ভোগ্য বা উপভোগ্য বস্তুটি হালাল তথা পবিত্র ও অনুমোদিত হতে হবে। দ্বিতীয়ত তা অর্জনের পথ বা মাধ্যমও বৈধ হতে হবে। এ দুয়ের কোনো একটির ব্যত্যয় ঘটলে বস্তুটি হারাম বলে বিবেচিত হবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘চারটি জিনিস যখন তোমার মধ্যে পাওয়া যাবে, তখন দুনিয়ার অন্য সবকিছু না হলেও কিছু যায় আসে না। তা হলো, আমানতের সংরক্ষণ, সত্য কথা বলা, সুন্দর চরিত্র, হালাল উপার্জনে খাদ্যগ্রহণ।’ (মুসনাদে আহমদ : ৬৬৫২)।

হালাল জীবিকা নির্বাহের বিধান : একজন মোমিনকে যেমন তার যাপিত জীবনে বিশ্বাস, ইবাদত, লেনদেন, মেলামেশা, আখলাক- সবক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিধিবিধান মেনে চলতে হয়, তেমনিভাবে জীবনোপকরণ এবং জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত বিধি-নিষেধের আওতায় থাকতে হয়। মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ ভোগ-উপভোগের রকমারি উপকরণ সবই রিজিকের অন্তর্ভুক্ত। আর রিজিকের সঙ্গে হালাল-হারামের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হালাল উপার্জনের নির্দেশ প্রদান করে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘হে মানবজাতি! তোমরা পৃথিবী থেকে হালাল ও পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা : ১৬৮)। ইমাম কুরতুবি (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইসলামি স্কলার ও বিদ্বানদের কিছু অমূল্য অভিমত তুলে ধরেছেন। সাহল বিন আবদুল্লাহ (রহ.) বলেন, ‘তিনটি বস্তু মুক্তির উপায়- হালাল খাবার গ্রহণ করা, ফরজগুলো আদায় করা এবং নবী করিম (সা.)-এর অনুসরণ করা।’

সাঈদ বিন ইয়াজিদ (রহ.) বলেন, ‘আমল পরিপূর্ণতা লাভ করে পাঁচটি গুণে। তা হলো, আল্লাহর প্রতি ঈমান, সত্যের পরিচয় লাভ, আল্লাহর জন্য ইখলাসপূর্ণ আমল, সুন্নাহ মোতাবেক জীবনযাপন ও হালাল খাদ্য গ্রহণ। আর এর একটিও নষ্ট হলে আমল কবুল হবে না।’ (তাফসিরে কুরতুবি : ২/২০৮)। কারণ, কেউ যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে; কিন্তু সত্যের পরিচয় তার সামনে স্পষ্ট না থাকে, ঈমান দ্বারা সে যথাযথ উপকৃত হতে পারবে না।

সত্যের পরিচয় পেল, কিন্তু ঈমান আনল না; সেও পথভ্রষ্ট। ঈমান আনল, সত্যও চিনল, কিন্তু আমলে ইখলাস নেই; সেও প্রবঞ্চিত। আগের চারটি বিদ্যমান; কিন্তু খাবার হালাল নয়, তার ইবাদতও কোনো কাজে আসবে না। হালাল উপার্জন অন্যতম ফরজ ইবাদত। হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) বলেন, ‘হালাল জীবিকা সন্ধান করা নির্ধারিত ফরজসমূহের পরে বিশেষ একটি ফরজ।’ (সুনানে বায়হাকি : ৬/১২৮)।

ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত : ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য উপার্জন হালাল হওয়া অপরিহার্য। সমাজ জীবনে অনেক মানুষকে দেখা যায়, তারা ইবাদতের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দান-সদকা সবক্ষেত্রেই অগ্রগামী। কিন্তু এসব ইবাদত শত কষ্ট ও ধৈর্যসহ করলেও তাদের উপার্জন ও রিজিক হালাল না হওয়ায় সব ভেস্তে যায়। রিজিক হালাল না হলে বান্দার দোয়াও কবুল হয় না। মুসলিম শরিফে আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে একটি বর্ণনা আছে, যা ইবাদত ও দোয়া কবুল হওয়ার জন্য পানাহার ও পোশাক হালাল হওয়ার আবশ্যকীয়তার ওপর সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। তিনি মোমিনদেরও সেই আদেশ করেছেন, কোরআনে যে আদেশ করেছেন তার রাসুলদের। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর ও সৎকর্ম কর।’ (সুরা মোমিনুন : ৫১)। ঈমানদারদের লক্ষ্য করে তিনি বলেন, ‘হে মোমিনরা! আমার দেওয়া রিজিক থেকে পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর।’ (সুরা বাকারা : ১৭২)। এরপর রাসুল (সা.) এমন এক ব্যক্তির আলোচনা করলেন, যে দীর্ঘ সফর করেছে। চুল উস্কো খুস্কো। বদন ধূলিমলিন। সে আকাশের দিকে হাত প্রসারিত করে ডাকে, ‘হে আমার রব! হে আমার রব!’ কিন্তু তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় হারাম, লালিত-পালিতও সে হারাম খাবারে। ফলে কী করে তার দোয়া কবুল হতে পারে? (মুসলিম : ১০১৫)।

হালাল পানাহারের প্রভাব : মানুষের পেটে যা পড়ে, মন-মেজাজে ও আচরণে তার প্রভাব থাকেই। শরীরের সঙ্গে যা আহার্য হিসেবে মিশে যায়, বাহ্যিকভাবেও তার বিরাট ক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। হালাল পানাহারের যেমন শারীরিক প্রভাব রয়েছে, রয়েছে আত্মিক প্রতিক্রিয়াও।

এর মাধ্যমে হৃদয় আলোকিত হয়, অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়, ইবাদতে একাগ্রতা হাসিল হয়। ব্যবহার্যসামগ্রী ও ভোজ্য খাবার হালাল হলে মন-মননে সৃষ্টি হয় নেক আমলের প্রতি দুর্বার আগ্রহ ও উদ্দীপনা। ফরজের সঙ্গে নফলের প্রতিও জাগে প্রেরণা। দূরীভূত হয় পারিবারিক কলহ ও অশান্তি। হালালের প্রভাব যেমন ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে রয়েছে, রয়েছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও। এতে দেশে সৎ নিষ্ঠাবান ও আল্লাহভীরু মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

ফলে রাষ্ট্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম হ্রাস পায়। কমে আসে অশ্লীলতা, ধর্ষণ, ইভটিজিং, হত্যাকাণ্ড, মাদকদ্রব্য, চুরি-ডাকাতি, সুদ-ঘুষ, কালোবাজারি, ওজনে কম দেওয়া, দ্রব্যে ভেজাল দেওয়া, ছিনতাই, জুয়া, গুদামজাতসহ যাবতীয় অন্যায় ও পাপাচারের হার। এতে দেশে প্রবাহিত হয় শান্তির সুবাতাস। বিদায় নেয় অবক্ষয়ের করাল গ্রাস। আর যদি হালালের বিপরীতে হারামের জয়জয়কার হয়, তাহলে পরিণামে ধেয়ে আসে বিনাশ ও অধঃপতনের বাঁধভাঙা জোয়ার। নেমে আসে জীবন বিধ্বংসী কাল বৈাশাখী ঝড়। জাতির কপালে জোটে চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তি। আল্লাহতায়ালা মহাগ্রন্থ আল কোরআনে হালাল খাবারের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু আহার কর ও সৎকর্ম কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, তা সম্পর্কে আমি অবগত আছি।’ (সুরা মোমিনুন : ৫১)।

হালাল উপার্জন,জরুরি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত