ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত: ‘গুপ্তখালে’ বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত: ‘গুপ্তখালে’ বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজার ভ্রমণে আসেন প্রতিদিন হাজারো পর্যটক। সাপ্তাহিকের পাশাপাশি টানা ছুটির বিশেষ দিনগুলোতে সমাগম ঘটে লাখো পর্যটকের। কিন্তু তাদের আনন্দ উদযাপনের মাত্রা মাঝে মধ্যে রূপ নেয় শোকযাত্রায়। এবার ঈদের টানা ছুটির দিনে ২৪ ঘণ্টায় সাগরজলে গোসলে নেমে বাবা-ছেলেসহ ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে গত ১০ বছরে সৈকতে গোসলে নেমে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে, এই সময়ে উদ্ধার ৭৮২ জন।

সৈকতের স্নানরত পর্যটকের নিরাপত্তায় নিয়োজিত লাইফ গার্ড কর্মীরা জানিয়েছেন, বালির সৈকতে স্রোতের টানে এবং বর্ষার ঢলে অসংখ্য গুপ্তখাল সৃষ্টি হয়। আবার এসব গুপ্তখাল সময়ের পর পর পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে গুপ্তখালের কারণে ক্রমাগত বাড়ছে মৃত্যুর ঝুঁকি। এর মধ্যে ১২০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতে মাত্র ৩ কিলোমিটার এলাকায় দায়িত্ব পালন করে লাইফ গার্ড কর্মী। অপর ১১৭ কিলোমিটার নেই কোন প্রকার নজরদারি। এই ৩ কিলোমিটার এলাকায় ২৭ জন লাইফ গার্ড কর্মীও পর্যাপ্ত না বলে মনে করেন তারা। একই সঙ্গে লাইফ গার্ড কর্মীরদের পর্যাপ্ত উদ্ধার সরঞ্জামও নেই। এর মধ্যে সৈকতে গোসলে নামা পর্যটকরা নিদের্শনা না মানায় মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে ক্রমাগত।

দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ভ্রমণে আসা পর্যটকদের গোসলের নিরাপত্তায় বেসরকারি একটি সংস্থার অধীনে সৈকতে নিয়োজিত রয়েছে সী সেইফ লাইফ গার্ড সংস্থা নামের একটি প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক দশক ধরে দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটির টিম ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বর্ষা মৌসুম হওয়ায় বছরের এই সময়টাতে সাগর উত্তাল ও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এতে প্রতিটি জোয়ার-ভাটায় সাগরের তলদেশ একেক সময় একেক রূপ ধারণ করে কোথাও গুপ্ত খালের; কোথাওবা প্রবল স্রোতের টানের সৃষ্টি হয়। বালি সৈকত হওয়ায় এসব গুপ্তখাল সমূহ এক সময় এক-এক স্থানে পরিবর্তন হচ্ছে। গুপ্তখাল চিহ্নিত করা খুব কষ্টের। ফলে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে সাগরে গোসলে নেমে মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ে।

তিনি বলেন, আগত পর্যটকরা সৈকতের স্নানের নিদের্শনা মানেন না। অনেক পর্যটক সাঁতার না জেনেও অনেক দূরে চলে যায়। মূলত যেখানে লাল পতাকা রয়েছে ওখানে গোসল করা যাবে না।

তিনি বলেন, সৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা ও লাবণী পয়েন্ট এই ৩ কিলোমিটার এলাকায় লাইফ গার্ড কর্মীদের নজরদারি রয়েছে। অপর এলাকায় কোন লাইফ গার্ড কর্মী থাকে না। মাত্র ২৭ জন কর্মী দ্বারা এই ৩ কিলোমিটার এলাকা শতভাগ নিরাপত্তা সম্ভব হচ্ছে না। এই এলাকা ১ শত জন লাইফ গার্ড কর্মী এবং ১০ টি পয়েন্টে তাদের অবস্থান থাকা অত্যন্ত জরুরি।

একই সঙ্গে উদ্ধার সরঞ্জামের সংকট রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, উদ্ধারের জন্য আধুনিক সরঞ্জামের জরুরি। বিশেষ করে দ্রুতগামী আধুনিক জেটস্কি খুবই প্রয়োজন রয়েছে। সৈকতের জন্য আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স, সৈকতের পাড়ে একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকা দরকার।

এক বছরে সাগরে গোসলে নেমে মৃত্যু হয়েছে ৮ জন পর্যটকের এবং উদ্ধার করা হয়েছে ৭৮ জন। গত এক দশকে ৬০ জনের মৃত্যু এবং ৭৮২ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে জানিয়ে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, কক্সবাজার সৈকতে পরীক্ষামূলক সী নেটিং ব্যবস্থা চালু করে দেখা যেতে পারে। বর্ষাকালে কার্যকর না হলেও অন্যান্য সময় তা নিরাপত্তায় সহযোগী হতে পারে।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দায়িত্বপালনকারী সী সেফ লাইফ সংস্থার সিনিয়র লাইফ গার্ড কর্মী মোহাম্মদ শুক্কুর বলেন, সৈকতে ৩ স্তরের দায়িত্ব পালন করছে লাইফ গার্ড কর্মীরা। লাইফ গার্ড কর্মীরা টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষক, বালিয়াড়িতে টহল ও বোট নিয়ে পানিতে অবস্থান করছে। কিন্তু পর্যটকদের সচেতন হতে হবে বেশি। তাদেরকে লাইফ গার্ড কর্মীদের নির্দেশনা মানতে হবে, তা না হলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তারপরও লাইফ গার্ড কর্মীরা সজাগ রয়েছে।

তিনি বলেন, মূলত যে সব পয়েন্টে লাইফ গার্ডকর্মী থাকে না ওখানেই দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে। কেননা সৈকতের গুপ্ত খাল সমূহ চিহ্নিত করতে কষ্ট হয়। এক-এক সময় এক এক স্থানে পরিবর্তন হয় গুপ্তখাল। বর্ষার ঢলে সৃষ্ট হচ্ছে গর্তও। ফলে বাড়ছে স্নানের ঝুঁকি।

কক্সবাজার আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী সমিতির নেতা আবদুর রহমান জানান, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে ঘিরেই পর্যটনের নামে গড়ে উঠেছে হাজারো কোটি টাকা বিনিয়োগে নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রতিবছর সাগরের গোসলে নেমে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হলেও তা বন্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্টদের। এখানে সী নেটিং ব্যবস্থা, উদ্ধারের ব্যবস্থা এবং উদ্ধার কর্মীর সংখ্যা বাড়িয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি বলে জানান তিনি।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শহীদুল আলম জানান, ভ্রমণ পিপাসু মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে লাইফ গার্ড ও বিচ কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টিতে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে।

গুপ্তখাল,কক্সবাজার
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত