অনলাইন সংস্করণ
১৮:০৬, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ম হিজরির রমজান মাসে সংঘটিত হয় মক্কা বিজয়। এটি মহান বিজয় নামেও পরিচিত। মুহাম্মাদ (সা.) প্রায় রক্তপাতহীনভাবে ১০ হাজার সাহাবিকে নিয়ে মক্কা বিজয় করেন, যেখানে মক্কাবাসী সবাই মুসলিমদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ক্ষমা লাভ করে।
মক্কা বিজয়ের কারণ : কুরাইশরা হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করে বসল। ঠিক এ সময়েও নবীজি (সা.) বললেন, ‘আমরা চুক্তি ভঙ্গকারী নই, বিশ্বাসঘাতকও নই।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম)।
মদিনা থেকে রওয়ানা : ৮ম হিজরির ১০ রমজান আসরের নামাজের পর ১০ হাজার সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্য প্রিয় নবীজি (সা.) মদিনা মুনাওয়ারা থেকে রওয়ানা করেন। মক্কার পথে যুল হুলাইফা নামক স্থানে উপস্থিত হলে মুসলমানগণ দেখতে পেলেন আব্বাস (রা.) হিজরতের জন্য সপরিবারে মদিনার পথ ধরেছেন। নবীজি (সা.) আব্বাস (রা.) কে বললেন, ‘হে আব্বাস, তোমার এই হিজরতই শেষ হিজরত আর আমার নবুওত হলো সর্বশেষ নবুওত।’ (মুসলিম)। এশার সময় মুসলিম সেনাদল মাররুজ জাহরানে এসে উপনীত হন এবং নবীজির নির্দেশে এখানেই ছাউনি ফেলেন। এক রাতে আবু সুফিয়ান, হাকিম ইবনে হিজাম এবং বুদাইল ইবনে ওয়ারাকা মুসলমানদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে মাররুজ জাহরানে পৌঁছল। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাহারাদারেরা দেখামাত্রই তাকে বন্দি করে ফেলল এবং তাদেরকে নবীজি (সা.)-এর কাছে নিয়ে আসল। এখানেই আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন। (বোখারি)।
মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা : এই সময়ে আব্বাস (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আবু সুফিয়ান গর্ব করা পছন্দ করে। তার জন্য কিছু একটা করুন। নবীজি (সা.) বললেন, ‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়িতে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, যে ব্যক্তি মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, যে তার অস্ত্র ফেলে দিবে সে নিরাপদ, যে তার ঘরের দরজা বন্ধ করবে সে নিরাপদ, যে ব্যক্তি হাকিম ইবনে হিজামের বাড়িতে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ।’ (বোখারি, মুসলিম)।
নবীজি (সা.) আব্বাস (রা.) কে নির্দেশ দিলেন, ‘আবু সুফিয়ানকে সেনাদলের যাত্রাপথের সংকীর্ণ জায়গায় দাঁড় করাবে, যেন সে মুসলমানদের পুরো সেনাদলকে প্রত্যক্ষ করতে পারে।’ একের পর এক গোত্র দল বেঁধে যেতে লাগল, তা দেখে আবু সুফিয়ান অভিভূত ও বিহ্বল হয়ে পড়ল। আবু সুফিয়ান বলল, আব্বাস, তোমার ভাতুষ্পুত্রের রাজত্ব তো এখন বড় হয়ে গেছে অনেক! আব্বাস (রা.) প্রতিবাদ করে বললেন, আবু সুফিয়ান, নিশ্চয়ই এটা নবুওত, রাজত্ব নয়। আবু সুফিয়ান তখন বলল, হ্যাঁ তাই। এটা নিশ্চয়ই নবুওত, রাজত্ব নয়। (তাবরানি)।
মক্কা বিজয় অভিযানের পতাকাবাহী : মক্কা বিজয় অভিযানে মুহাজির সাহাবিদের পতাকাবাহী ছিলেন জুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.) এবং আনসার সাহাবিদের পতাকাবাহী ছিলেন সাদ বিন ওবাদা (রা.)। সাদ মক্কায় প্রবেশের প্রাক্কালে আবু সুফিয়ানকে দেখে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে ফেললেন, আজ লড়াইয়ের দিন, আজ লড়াইয়ের জন্য কাবাকে হালাল করা হয়েছে। আবু সুফিয়ান এ বিষয়ে নবীজির দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নবীজি (সা.) বললেন, হে আবু সুফিয়ান, আজ রহমতের দিন। আল্লাহতায়ালা আজ কুরায়েশকে সম্মানিত করবেন। এরপর নবীজি (সা.) সাদের হাত থেকে পতাকা নিয়ে তুলে দিলেন তার ছেলে কায়েস (রা.)-এর হাতে। নবীজি (সা.) মক্কা বিজয়ের দিনে উটনীর পিঠে বসে সুমধুর সুরে সুরা ফাতাহ তেলাওয়াত করেছেন। (বোখারি)।
এ বিশাল বিজয়ের মুহূর্তে নবীজির পবিত্র চেহারায় যেমন ছিল আনন্দ, খুশি, বিজয় ও উৎফুল্লতার প্রকাশ, তেমনি তার সে নুরানি চেহারায় প্রতিভাত হচ্ছিল মহান আল্লাহর দরবারে বিনয়, নম্রতা ও নিঃস্বতা। নবীজি (সা.) উটের পীঠে সওয়ারি হয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন। তার মাথা ছিল অবনত। বিনয়ে এতটাই ঝুঁকে ছিলেন যে তার দাড়ি মুবারাক উটের হাওদার কাঠে ছোঁয়া লাগছিল। মক্কায় প্রবেশের সময় সকল মানুষ নবীজিকে দেখছিল। নবীজি বিনয় ও নম্রতায় মাথা ঝুঁকে বসে ছিলেন।
মক্কা বিজয়ের পর নবীজি (সা.) যখন দেখলেন দলে দলে মানুষ ইসলামে দাখিল হচ্ছে, তখন তিনি বললেন, এটা আমার রবের ওয়াদা। এটা আমার রবের প্রতিশ্রুতি। অতঃপর তিনি সুরা নসর তেলাওয়াত করলেন।
আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণের পর নবীজি (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুসংবাদ নিয়ে দ্রুত মক্কায় প্রবেশ করলেন আর তার দরাজ কণ্ঠে আহ্বান জানালেন, ‘হে কুরাইশ বংশের লোকেরা, মুহাম্মাদ তার অভূতপূর্ব শক্তি সামর্থ্য নিয়ে তোমাদের সামনে হাজীর হয়েছে। যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়িতে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ থাকবে। লোকজন বলল, আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন, শুধুমাত্র তোমার বাড়ি আমাদের কি উপকারে আসবে? আবু সুফিয়ান বলল, যে ব্যক্তি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে নিরাপত্তা চাইবে সে নিরাপদ, আর যে ব্যক্তি মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ থাকবে। (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া)।
রাসুল (সা.) মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং সূচনাতেই তিনি আবুতালিব কন্যা উম্মেহানির ঘরে গেলেন। উম্মেহানি বলেন, ‘নবীজি (সা.) তার বাড়িতে প্রবেশ করলেন, গোসল করলেন এবং ৮ রাকায়াত নামাজ আদায় করলেন।’ (বোখারি)। এই নামাজ সালাতুল ফাতাহ বা বিজয়ের নামাজ হিসেবে পরিচিত।
মসজিদে হারামে প্রবেশ : রাসুল (সা.) যখন হারাম শরিফ এলাকায় প্রবেশ করেন তখন কাবা ঘরের আশেপাশে ৩৬০টি মূর্তি রাখা ছিল। তিনি মূর্তিগুলোর দিকে হাতের লাঠি দ্বারা ইশারা করছিলেন আর পড়ছিলেন, ‘সত্য সমাগত হয়েছে আর মিথ্যা হয়েছে অপসৃত।’ মূর্তিগুলো অধঃমুখী হয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। (বায়হাকি)।
নবীজির ভাষণ : মক্কা বিজয়ের দ্বিতীয় দিনে নবীজি (সা.) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন, যেখানে তিনি ঘোষণা করেন যে ইসলামে জাহেলি যুগের সকল প্রথা ও অহংকার বিলুপ্ত হয়েছে এবং আল্লাহর কাছে মুত্তাকিরাই শুধু সম্মানিত। তিনি বলেন যে একমাত্র আল্লাহই সম্মান, মর্যাদা এবং ক্ষমতার অধিকারী এবং তিনি মক্কাকে কেয়ামত পর্যন্ত হারাম ও পবিত্র ঘোষণা করেন, যেখানে রক্তপাত ও গাছ কাটা নিষিদ্ধ। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘হে মানবম-লী জেনে রাখো, জাহেলিয়াতের যত কাজ তার সবই রাখা হয়েছে আমার পদতলে।’ (মুসলিম)।
নবীজি (সা.) বললেন, ‘হে কুরাইশ সম্প্রদায়, তোমাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করব বলে তোমরা ধারণা করছ? তারা বলল, ‘উত্তম আচরণ। আপনি তো আমাদের উত্তম ভাই ও উত্তম ভ্রাতুষ্পুত্র।’ নবীয়ে রহমত (সা.) বললেন, ‘আজ আমি তোমাদের তাই বলব যা ইউসুফ (আ.) তার ভাইদের বলেছিল। তা হলো তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অভিযোগ নেই। যাও আজ তোমরা সবাই মুক্ত।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম)। এতদিন যারা নবীজির পথে কাটা বিছিয়েছে, পাথর ছুঁড়ে শরীর রক্তাক্ত করেছে, তার বিরোধিতা ও ক্ষতিসাধনে সদা তৎপর থেকেছে, তাকে এবং তার সাহাবিদের নির্যাতন করেছে, হত্যা করেছে, তাড়িয়ে দিয়েছে, তাদের সবাইকে তিনি একবাক্যে ক্ষমা করে দিলেন, ‘যাও আজ তোমরা সবাই মুক্ত।’ (ইবনু হিশাম)। চরম বেআদব, হিংস্র ও নৃশংস ১৫ জন কাফেরকে তাদের জঘন্য অপরাধ আর অমানবিক কাজের জন্য হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়। নিরাপত্তা ও ক্ষমা ভিক্ষা করলে এদের মাঝ থেকেও অধিকাংশকেই দয়ার নবীজি ক্ষমা করে দেন অবশেষে। আবু জাহেলের ছেলে ইকরামা, হিনদা বিনতে ওতবা, ওয়াহশি ইবনে হারব, কাব বিন জোহাইরের মতো ব্যক্তিরাও এই ক্ষমার আওতাভুক্ত হয়েছিল।
কাবা ঘরের দরোজায় আজান : রাসুলুল্লাহ (সা.) জোহরের নামাজের সময়ে বেলাল (রা.)-কে কাবা ঘরের দরজায় উঠে আজান দিতে নির্দেশ দিলেন। মুশরিকরা সতর্ক হয় যেন।’ (বায়হাকি)।
আবু মাহজুরাকে মক্কার মুয়াজ্জিন নিয়োগ : আবু মাহজুরা আলজামহি ছিলেন মসজিদে হারামের মুয়াজ্জিন এবং নবীজি (সা.)- এর সাহাবি। তিনি ছিলেন সবচেয়ে উচ্চ আওয়াজ এবং সুন্দর কণ্ঠ বিশিষ্ট।
ইমাম জাহাবি বলেন, ‘নবীজি (সা.)-এর চারজন মুয়াজ্জিন ছিলেন। মদিনায় দুইজন, বেলাল ইবনু রাবাহ যিনি নবীজির জন্য প্রথম আজান দিয়েছেন, আর একজন হলেন অন্ধ আমর ইবনু উম্মে মাকতুম আলকারাশি আলআমেরি। কুবায় সাদ আলকারাজ মাওলা আম্মার ইবনু ইয়াসার, মক্কায় আবু মাহজুরা।’ (ইবনুল কাইয়িম)।
রক্তপাতহীন বিজয় : মুসলমানরা বিনা যুদ্ধেই মক্কা দখল করে নেন। মুসলমানেরা ১২ জন কাফেরকে হত্যা করে এবং বাকিরা সবাই নিরাপত্তার আশ্রয় গ্রহণ করে। আর মুসলমানদের মধ্যে দুজন শহিদ হন।’ (ইবনে সাদ)।
বিজয়ের প্রভাব : মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম দ্রুত আরব উপদ্বীপের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, যা ইসলামের প্রসারে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। মক্কা সারা দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য দ্বীনি কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হলো।