ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মধ্যপন্থার ধর্ম ইসলাম

মধ্যপন্থার ধর্ম ইসলাম

‘মধ্যপন্থা’ ইসলামের অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য; যা ‘ভারসাম্য’ বলেও অভিহিত। মধ্যপন্থা বা ভারসাম্য বলতে দুটি পরস্পরবিরোধী বিষয়ের মাঝে এমন সমন্বয়কে বোঝায়, যাতে কোনো একটি বিষয় অতিরিক্ত প্রাধান্য না পায় এবং অপরটি অবহেলিত ও উপেক্ষিত না হয়। খোদায়ি দাসত্ব, আধ্যাত্মিকতা ও বস্তুবাদ, পরকাল ও ইহকাল, ওহি ও বুদ্ধি, অতীত ও ভবিষ্যত, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সমষ্টিগততা, স্থিরতা ও পরিবর্তন- এসবে ইসলাম ভারসাম্য বজায় রাখে। এ ভারসাম্য মানে হলো, প্রতিটি বিষয়ের অধিকার ও সীমা সংরক্ষণ করা; যাতে কোনো কিছুর প্রতি অবিচার, অতিরঞ্জন বা জুলুম না হয়।

আকিদা ও দর্শনে ভারসাম্য : অনেকে আকিদা-বিশ্বাসে অতিরঞ্জন করে। আবার অনেকে বস্তুবাদী; যারা কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিস ছাড়া অন্য কিছু মানে না। ইসলাম এ দুই সীমালংঘনের মাঝে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পথ দেখায়। এমন বিশ্বাসের আহ্বান জানায়, যা যুক্তি ও প্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা প্রমাণ পেশ কর, যদি সত্যবাদী হও।’ (সুরা বাকারা : ১১১)। কিছু মানুষ স্রষ্টার অস্তিত্বই মানে না। আবার অনেকে গাছ, পাথর, প্রাণী বা মূর্তিকে উপাস্য মনে করে। ইসলাম এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের আহ্বান জানায়, যিনি সবকিছুর স্রষ্টা। তিনি ছাড়া কোনো সৃষ্টি উপাস্য হতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর কাছে প্রার্থনা করে, তারা পথভ্রষ্ট।’ (সুরা আহকাফ : ৫)। কিছু মানুষ এ দুনিয়াকে একমাত্র সত্য মনে করে। অনেকে আবার একে কল্পনা বা মরীচিকা ভাবে। ইসলাম বলে, এ বিশ্বজগত সত্য; কিন্তু এর পেছনে রয়েছে আরেকটি মহান সত্য। আল্লাহ এটি সৃষ্টি করেছেন ও পরিচালনা করছেন।

ইবাদতে মধ্যপন্থা : কিছু ধর্ম ইবাদতকে পুরোপুরি অস্বীকার করে, আবার কিছু ধর্ম বলে, দুনিয়া ছেড়ে কেবল ইবাদতে মগ্ন থাকতে। ইসলাম এ দুই চরমের মাঝে পথ দেখায়। ইসলাম মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট ইবাদতের নির্দেশ দেয়। যেমন- দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজানের রোজা, জীবনে একবার হজ। এগুলোর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। কিন্তু ইবাদতের পর সে দুনিয়ার কাজে ফিরে যেতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ ছিল মধ্যপন্থা। যেখানে রোজা, নামাজ, পরিবার, বিশ্রাম, বন্ধুদের হক- সবকিছুর ভারসাম্য বজায় রাখা হয়।

আবদুল্লাহ ইবনে আমরের ঘটনা তারই প্রমাণ। তিনি ছিলেন কুরাইশের সন্তান। তার পিতা আমর ইবনুল আাস খন্দকের যুদ্ধের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু এ সৌভাগ্যবান সাহাবি অল্প বয়সেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গ দেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক। জিহাদে নিয়মিত অংশ নিতেন। জ্ঞানার্জনের জন্য প্রচুর সময় দিতেন। পাশাপাশি এমনভাবে ইবাদত-সাধনায় আকৃষ্ট ছিলেন, তা সন্ন্যাসবাদের সীমা ছুঁয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) এটি জানতে পেরে তাকে ডাকলেন। এ ঘটনার বর্ণনাকারী আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) নিজেই।

তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি নাকি সারাদিন রোজা রাখ এবং সারারাত নামাজে কাটাও?’ তিনি বললেন, ‘জী, সত্য।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে নিষেধ করলেন। বললেন, ‘একটানা রোজা রেখ না। কখনও রেখ, কখনও ছেড়ে দিও। রাতভর নামাজে দাঁড়িয়ে থেক না। রাতের কিছু অংশ ইবাদতে কাটাও, আর কিছু অংশ বিশ্রামে। তোমার শরীরেরও তোমার ওপর হক আছে, তোমার চোখেরও হক আছে, তোমার স্ত্রীরও হক আছে এবং তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসা বন্ধু-বান্ধবেরও হক আছে। তোমার জন্য যথেষ্ট হলো, তুমি প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখবে। এতে স্থায়ী রোজাদার হিসেবে গণ্য হবে। কারণ, প্রতিটি নেকির বিনিময়ে দশগুণ পুরস্কার দেওয়া হবে।’ (বোখারি : ১৯৭৬, মুসলিম : ১১৫৯)।

আখলাকে মধ্যপন্থা : কিছু মানুষ মনে করে, মানুষ ফেরেশতার মতো; তাই তাদের জন্য এমন নৈতিক মানদ- তৈরি করে, যা পূরণ করা অসম্ভব। আবার কিছু মানুষ মানুষকে পশুর মতো মনে করে। ইসলাম বলে, মানুষ একটি সমন্বিত সৃষ্টি। তার মধ্যে বুদ্ধি, প্রবৃত্তি ও আধ্যাত্মিকতা রয়েছে। সে ভালো ও মন্দ- দুই পথেই যেতে পারে। তার সবচেয়ে বড় কাজ হলো নিজের নফসের সঙ্গে জিহাদ করা, যাতে সে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘যে তার নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে, সে সফল; আর যে তাকে দমিয়ে রেখেছে, সে ব্যর্থ।’ (সুরা শামস : ৭-১০)। ইসলাম মানুষকে রুহ ও দেহের সমন্বয় হিসেবে দেখে। আল্লাহ মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে তার রুহ ফুঁকে দিয়েছেন। তাই ইসলাম রুহ ও দেহ- দুইয়েরই অধিকার রক্ষা করে।

আইনে মধ্যপন্থা : ইসলামের আইনিব্যবস্থাও মধ্যপন্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিছু ধর্ম অনেক কিছুকে হারাম করে দিয়েছে, যা আল্লাহ হারাম করেননি। আবার কিছু ধর্ম এমন জিনিস হালাল করেছে, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। ইসলাম হালাল ও হারামের অধিকার কেবল আল্লাহর হাতে রেখেছে। আল্লাহ পবিত্র ও উপকারী জিনিস হালাল এবং অপবিত্র ও ক্ষতিকর জিনিস হারাম করেছেন। (সুরা আরাফ : ১৫৭)। পারিবারিক বিষয়েও ইসলাম মধ্যপন্থী। যেমন- ইসলাম একাধিক বিয়ের অনুমতি দেয়, তবে শর্ত হলো ন্যায়বিচার ও আর্থিক সামর্থ্য। যদি কেউ ন্যায়বিচার করতে না পারে, তবে তার জন্য এক স্ত্রীতেই সন্তুষ্ট থাকা বাধ্যতামূলক। (সুরা নিসা : ৩)। তালাকের ক্ষেত্রেও ইসলাম মধ্যপন্থী। কিছু ধর্ম তালাককে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে, আবার কিছু তালাককে এতটা সহজ করে দেয়, বৈবাহিক বন্ধন ভঙ্গুর হয়ে যায়। ইসলাম তালাককে বৈধ করেছে; তবে তা শেষ পন্থা হিসেবে, যখন আর কোনো সমাধান থাকে না। (সুরা বাকারা : ২২৯)।

ব্যক্তি ও সমাজে মধ্যপন্থা : ইসলাম ব্যক্তি ও সমাজেও ভারসাম্য রক্ষা করে। লিবারেলিজম বা কথিত উদারবাদ ব্যক্তিকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দেয়। আর সমাজতন্ত্র সমাজকে। ইসলাম দুইয়ের মাঝে একটি ন্যায়সঙ্গত সমন্বয় সাধন করে। এটি ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সমাজের কল্যাণ- দুইয়েরই অধিকার ও দায়িত্ব নিশ্চিত করে। ইসলাম ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করে; কিন্তু সমাজের প্রতি তার দায়িত্বও ভোলে না। এভাবে ইসলাম একটি সুন্দর ও সুষম সমাজ গড়ে তোলে, যেখানে কেউ কারও ওপর জুলুম করে না। ইসলামের এ মধ্যপন্থা তাকে স্বভাবজাত দ্বীন করে তুলেছে; যা মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল্লাহ মানুষকে যে প্রকৃতি দিয়েছেন, তাতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সমষ্টিগততা রয়েছে। ইসলাম এই দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য রেখে মানুষকে একটি পরিপূর্ণ জীবনের পথ দেখায়।

ইসলাম,মধ্যপন্থা,ধর্ম
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত