
মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)। তিনি ছিলেন নবী, সিদ্দিক ও আল্লাহর পরম বন্ধু। কাবাঘরের নির্মাতা ও মানুষের নেতা। আল্লাহতায়ালা তাঁর বংশধরকে নবুওয়াত ও আসমানি কিতাবের জন্য মনোনিত করেছেন। কেয়ামতের দিন তাঁকেই প্রথম কাপড় পরানো হবে। (সুরা হজ : ৭৮; সুরা নিসা : ১২৫; সুরা বাকারা : ১২৭; সুরা আনকাবুত : ২৭)।
ইবরাহিম (আ.)-এর বাবা ছিলেন আজার। ইরাকের ছোট শহর ‘আওরে’ থাকতেন তারা। ফাদ্দান গোত্রের লোক ছিলেন তারা। আজার ছিলেন কট্টোরপন্থি মূর্তিপূজক ও মূর্তিদের তত্ত্বাবধায়ক। কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। সম্প্রদায়ের বিভিন্ন গোত্রের জন্য মূর্তি বানিয়ে বিক্রি করতেন। (কাসাসুল কোরআন, মুহাম্মদ হিফজুর রহমান, অনুবাদ: আব্দুস সাত্তার আইনী, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১৪)। বাবার কাজ আর মূর্তিপূজা ইবরাহিম (আ.)-এর পছন্দ ছিল না। তিনি দূরে দূরে থাকতেন। তিনি আশ্চর্য হতেন, বাবা নিজ হাতে মূর্তি বানান, চোখ, কান, নাক লাগান; আবার সেগুলোর পূজা করেন। তিনি বাবার এসব কর্মকাণ্ড ঘৃণার পাশাপাশি প্রকৃত উপাসককে খুঁজতেন। রাতের চাঁদ, আকাশের তারা, দিনের সূর্যের মধ্যে প্রভুকে খুঁজতেন। পরক্ষণে ভাবতেন, এর নিয়ন্ত্রণে নিশ্চয়ই কেউ আছেন। যিনি চাঁদে আলো দেন, তারা ফুটান, তারায় তারায় সৌন্দর্য দেন, দিন আনেন, সূর্যের আলোয় পৃথিবী ফর্সা করেন। এক দিন সত্য পথ ও আলোর খোঁজ পান। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আমি তো এর আগে (প্রথম থেকেই) ইবরাহিমকে (হেদায়েত ও) সৎপথের জ্ঞান দান করেছিলাম এবং আমি তার (কার্যকলাপ) সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলাম।’ (সুরা আম্বিয়া : ৫১)।
আল্লাহতায়ালা ইবরাহিম (আ.)-কে এর মধ্যে নবী করলেন। তিনি দেখলেন, নিজের ঘর বড় অন্ধকার। বাবার ঘরই মূর্তিনির্মাণ ও মূর্তিপূজার কেন্দ্র। বাবাকে একাত্ববাদের দাওয়াত দিলেন। মূর্তিগুলোর দুর্বলতা, বাবার ভ্রান্তচিন্তা ও আল্লাহর বড়ত্বের পরিচয় তুলে ধরলেন। বাবা শুনলেন না তাঁর কথা। বললেন, ‘তুমি যদি মূর্তিগুলোর নিন্দা করা থেকে বিরত না হও, তোমাকে পাথর মেরে মেরে ফেলব। নিজের ভালো চাইলে আমার থেকে দূর হয়ে যাও।’ ইবরাহিম বাবার সঙ্গে পারলেন না। বাবার সংসার ছাড়লেন।’ (সুরা মরিয়ম : ৪-৪৮)।
বাবার থেকে পৃথক হয়ে গোত্রের অন্য লোকদের দাওয়াত দিলেন ইবরাহিম (আ.)। কেউ তাঁর কথা শুনল না। তিনি চেষ্টা করেই চললেন। কাজ হলো না। (কাসাসুল কোরআন, মুহাম্মদ হিফজুর রহমান, অনুবাদ : আব্দুস সাত্তার আইনী, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ২৫)। ইবরাহিম (আ.) মূর্তিগুলোর দুর্বলতা ও অসারতা প্রমাণের সুযোগ খুঁজছিলেন। পেয়েও গেলেন সেবার। সেসময় তার গোত্রের একটি ধর্মীয় মেলা হলো। সবাই চলল মেলায়। তাঁকেও যেতে বলল কেউ কেউ।
তিনি অসুস্থতার দোহাই দিলেন। যখন সম্প্রদায়ের লোকেরা মেলায় নেশা ও আনন্দে বুঁদ, তখন তিনি দেবতাদের মন্দিরে প্রবেশ করে প্রধান মূর্তটি ছাড়া সবগুলো চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেললেন। প্রধানটির কাঁধে রেখে দিলেন কুঠার। এই ঘটনার বর্ণনা কোরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘এরপর সে প্রধান মূর্তিটি ছাড়া চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল মূর্তিগুলোকে, যাতে তারা (মূর্তিপূজকরা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী) তার দিকে ফিরে আসে।’ (এবং জিজ্ঞেস করে, এটা কী হয়ে গেল?) (সুরা আম্বিয়া : ৫৮)
মেলা থেকে ফিরে লোকেরা এ অবস্থা দেখে ক্রুব্ধ হলো। পরস্পর জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে জানতে চাইল, এ দুঃসাহস কার? একজন বলল, ‘এটা ইবরাহিম নামের যুবকের কাজ হতে পারে।’ তাঁকে ডেকে পাঠানো হলো। তিনি বললেন, ‘প্রধানটির কাজ। সেই এরকম করেছে। তোমরা তাকে জিজ্ঞেস করো।’ তারা নিজেদের অসারতা ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের কথা বুঝতে পারল। নিজেদের সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে মেনে নিল। কিন্তু ঈমান আনল না। (সুরা আম্বিয়া : ৬৪-৬৭)।
এ খবর দ্রুতই তৎকালীন বাদশাহ নমরুদের (সেসময় ইরাকের বাদশহার উপাধি ছিল নমরুদ) কাছে পৌঁছে গেল। নমরুদ নিজেকে শুধু প্রজাদের রাজাই ভাবত না; তাদের খোদা ও মালিক মনে করত। প্রজারাও তাকে মানত ও পূজা করত। (কাসাসুল কোরআন, মুহাম্মদ হিফজুর রহমান, অনুবাদ : আব্দুস সাত্তার আইনী, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ২৬)।নমরুদ ইবারাহিম (আ.)-কে ডাকলেন। তাঁর সঙ্গে নমরুদের অনেক কথা হলো। যুক্তিতর্ক হলো। নমরুদ হেরে গেলেন। ইবরাহিম (আ.) তাকে একাত্মবাদের দাওয়াত দিলেন। আল্লাহর দাসত্ব স্বীকার করতে বললেন। নমরুদ কোনোভাবেই তার কথা শুনল না; বরং তাঁকে আগুনে নিক্ষেপের শাস্তি দিল। তারা একটা স্থান নির্ধারণ করল। এক মাস পর্যন্ত শহরবাসী জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করল। তাতে সাত দিন আগুন প্রজ্বালিত হলো। অগ্নিশিখা আকাশচুম্বী হলো। এর জ্বলন্ত শিখায় চারপাশের সব বস্তু ঝলসে যেতে লাগল। তারা যখন মনে করল, এই আগুন থেকে ইবরাহিমের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা নেই, তখন তাঁকে একটি চড়কের ওপর বসিয়ে আগুনে নিক্ষেপ করল। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মূল : মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা : ৮৮২)।
ইবরাহিম (আ.)-এর দেহে আগুনের সামান্য আঁচও লাগেনি; বরং নিরাপত্তাময় শীতল ও স্নিগ্ধ হয়ে গেল। তিনি শত্রুদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে বের হয়ে গেলেন। তাফসিরে মাজহারিতে আছে, ‘তিনি সাতদিন বেশ সুখে ছিলেন আগুনের ভেতর।’ পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তারা বলল, একে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য করো, যদি তোমরা কিছু করতে চাও। আমি বললাম, হে আগুন, তুমি ইবরাহিমের ওপর শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। তারা ইবরাহিমের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করল, অতঃপর আমি তাদেরই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম।’ (সুরা আম্বিয়া : ৬৮-৭০)।