
দারিদ্র্য মানবসমাজের একটি চিরন্তন সমস্যা, যা শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং নৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্যও বিনষ্ট করে। ইসলাম দারিদ্র্যকে মানবজীবনের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তা দূর করার জন্য বাস্তবসম্মত ও ন্যায়ভিত্তিক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইসলামের অর্থব্যবস্থা যৌক্তিক, নৈতিক ও ভারসাম্যপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত উভয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় ইসলাম কার্যকর নীতিমালা দিয়েছে।
সুদ যেহেতু অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে, এজন্য আল্লাহতায়ালা সুদকে চিরন্তনভাবে হারাম ঘোষণা করেছেন। ইসলাম চায় না সম্পদ কেবল কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকুক। সমাজের সব স্তরে তা ন্যায্যভাবে বণ্টিত হোক, এটাই ইসলামের চাহিদা। এজন্যই ইসলামে জাকাত, সদকা, সদকাতুল ফিতর ও মিরাসের বিধান প্রণীত হয়েছে। পাশাপাশি ধনীদের অধিকহারে দান করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।
অপচয় রোধ : অপচয় ও অপব্যয় দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ। আবার অতিরিক্ত কৃপণতাও ইসলামে নিন্দনীয়। ইসলাম উভয়ের মাঝামাঝি মিতব্যয়িতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৭)। আরও বলা হয়েছে, ‘তোমরা খাও ও পান কর; কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীকে ভালোবাসেন না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)।
উপার্জনের গুরুত্ব : ইসলাম দারিদ্র্য বিমোচনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নিজ হাতে উপার্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। স্বনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদা রক্ষার এটি পছন্দনীয় উপায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে সুগম করে দিয়েছেন। অতএব, তোমরা এর দিগদিগন্তে বিচরণ কর এবং তাঁর দেওয়া রিজিক ভোগ কর।’ (সুরা মুলক : ১৫)। রাসলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ ভোরবেলা রশি নিয়ে পাহাড়ে যাবে, কাঠ কেটে বিক্রি করবে এবং তার অর্থ থেকে নিজে খাবে ও কিছু সদকা করবে; এটা তার জন্য কারও কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম।’ (বোখারি : ১৪৮০)।
ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্ব : ব্যবসা জীবিকা নির্বাহের সম্মানজনক ও ফলপ্রসূ মাধ্যম। নবী-রাসুলরাও ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রিয় নবী (সা.) মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে প্রথম ব্যবসায়িক সফর করেন। ব্যবসা মানুষকে পরিশ্রমী, সৎ ও আত্মনির্ভরশীল হতে শেখায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন নামাজ শেষ হবে, তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ কর (ব্যবসা-বাণিজ্য কর)। আর আল্লাহকে অধিক পরিমাণ স্মরণ কর, যেন তোমরা সফল হও।’ (সুরা জুমা : ১০)।
জাকাত ব্যবস্থা : জাকাত ইসলামের এক মহোত্তম সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এটি ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করে এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে। জাকাত আদায় ও বণ্টনের কাজ সঠিকভাবে পরিচালিত হলে সমাজ থেকে অভাবগ্রস্তের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমতে থাকবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের ধন-সম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে।’ (সুরা জারিয়াত : ১৯)। অতএব, জাকাত কোনো অনুগ্রহ নয়, এটা দরিদ্রদের ন্যায্য অধিকার।
সাধারণ দান : দান-সদকা মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। এটি দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি তাদের স্বাবলম্বী জীবন গঠনেও সহায়তা করে। এজন্য ইসলাম জাকাত-ফিতরার পাশাপাশি সাধারণ দানের প্রতিও উৎসাহ দিয়েছে। রাসলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর দান-সদকা করা জরুরি।’ (মুসলিম : ১০০৮)। আজকের বিশ্ব যখন আন্তর্জাতিকভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছে, তখন ইসলামের অর্থনীতি বিষয়ক নৈতিক ও যৌক্তিক নির্দেশনার আলোকে আমাদেরও দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।