
বর্তমান পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একজন মুসলিম নারীর হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ‘আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়’। মরক্কোর ফেজ নামক জায়গায় ৮৫৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন ফাতিমা আল-ফিহরি। আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়টি ইসলামিক বিশ্ব ও ইউরোপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেছিল।
ইউরোপের রেনেসাঁর কথা তো দুনিয়ার মানুষ জানে। সেসময় ইউরোপিয়ানদের গবেষণার কাজে সহায়তা করেছিল মুহাম্মদ আল ইদ্রিসের মানচিত্র। বিখ্যাত এই মানচিত্রকার ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করা অনেক পণ্ডিত তাদের কাজের মাধ্যমে বিশ্বকে প্রভাবিত করেছিলেন। তেমনি কিছু পণ্ডিত হলেন ইবনে রাশেদ আল-সাবতি, মুহাম্মদ ইবনে আলহাজ আল আবদারি আল-ফাসি, আবু ইমরান আল-ফাসি, তাত্ত্বিক মালিকি ও বিখ্যাত পর্যটক ও লেখক রাব্বি মুসিবিন মায়মন। প্রতিষ্ঠাতার পুরো নাম ফাতিমা বিনতে মুহম্মদ আল-ফিহরি আল-কুরাইশিয়া।
পারিবারিক নামের কুরাইশিয়া থেকে ধারণা করা হয় তিনি ছিলেন কুরাইশ বংশধর। ফাতিমা আল-ফিহরির জন্ম ৮০০ সালে বর্তমানের তিউনিসিয়ার কাইরাওয়ান শহরে। শহরটির গোড়াপত্তন হয় ৬৭০ সালে উমাইয়া শাসকদের হাতে। নবম শতকের শুরুতে শহরটি ছিল ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
ফাতিমার জন্মের কয়েক বছর পর তার পরিবারও শহরের অনেক অসচ্ছল পরিবারের মতো ভাগ্য ফেরাতে পাড়ি জমায় মরক্কোর ফেজ শহরে। এখন মানচিত্রে ফেজ শহর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটি এখন কসমোপলিটন শহর হিসেবে পরিচিত। ফেজের শাসক সুলতান দ্বিতীয় ইদ্রিস আগত বিদেশিদের ফেজ নদীর তীরে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। ফেজে এসে ফাতিমার বাবা মুহাম্মদ আল-ফিহরির ভাগ্য বদলে যয়। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হন তিনি। সন্তানদের সুশিক্ষার দিকে ছিল তার কড়া নজর। সে কারণে ফাতিমা ও তার বোন মরিয়ম আরবি ভাষা, ইসলামিক ফিকাহ ও হাদিস শাস্ত্র বিষয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পান। ফেজ শহরেই বিয়ে হয় ফাতিমার। কিন্তু বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের পরিবারে দুর্যোগ নেমে আসে। অল্প সময়ের মধ্যে বাবা, ভাই ও স্বামীকে হারান ফাতিমা। প্রিয়জন হারালেও দুই বোন পেয়ে যান বাবার রেখে যাওয়া বিপুল সম্পত্তি। এর মধ্যেই ফেজের মানুষের মুখে মুখে ফাতিমার একটা নতুন নাম রটে যায়। ‘উম্মে আল বানিয়ান’ বা ‘শিশুদের মা’। মানবতার কল্যাণে বাবার রেখে যাওয়া বিপুল সম্পত্তি ব্যয় করেন ফাতিমা। ততদিনে ফেজের খ্যাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল দেশ-বিদেশ থেকে আসা মুসলমানদের সংখ্যা। কিন্তু ফেজের কেন্দ্রীয় মসজিদে মুসল্লিদের জায়গা হচ্ছিল না। তখন দুই বোন দুটো মসজিদ নির্মাণ শুরু করলেন। মরিয়ম নির্মাণ করলেন আন্দালুস মসজিদ। আর ফাতিমা কারাওইন মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন ২৫৪ হিজরির রমজান মাসে, অর্থাৎ ৬৫৯ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে। নিজে উপস্থিত থেকে নির্মাণকাজের তদারকি করতেন ফাতিমা।
মসজিদ নির্মাণ শেষ হতে কতদিন সময় লেগেছিল- ১৮ বছর, নাকি ১১ বছর কিংবা ২ বছর তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে নির্মাণ শুরুর দিন থেকে শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি দিন তিনি রোজা রেখেছিলেন। নির্মাণ শেষে মসজিদের ভেতর ঢুকে নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানান ফাতিমা। তবে দিন-তারিখ জানা যায় না। জানা যেত, যদি ১৩২৩ সালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির ব্যাপক ক্ষতি না হতো। ধারণা করা হয়, ফাতিমা সম্পর্কে রাখা তথ্যগুলো ওই আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি বাড়তি জায়গায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন ফাতিমা।
ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি ব্যাকরণ, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, রসায়ন, ভূগোলসহ নানা বিষয়ে শিক্ষাদান শুরু হয় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটি নানা বিষয়ে উচ্চ ডিগ্রি প্রদানকারী প্রাচীনতম একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যা টানা সাড়ে ১১শ বছরেরও বেশি সময় ধরে চালু রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিকে বিশ্বের প্রাচীনতম লাইব্রেরি হিসেবে ধরা হয়। আগুনে পুড়ে বিপুল পরিমাণ পাণ্ডুলিপি নষ্ট হওয়ার পরও চার হাজারের বেশি প্রাচীন ও দুর্লভ পাণ্ডুলিপি রয়েছে এখনও। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নবম শতকে লেখা একটি কোরআন শরিফ, হাদিসের সংকলন, ইমাম মালিকির গ্রন্থ মুয়াত্তা, ইবনে ইসহাকের লেখা হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর জীবনী, ইবনে খালদুনের লেখা কিতাব আল-ইবার ও আল-মুকাদ্দিমার মূল পাণ্ডুলিপি।
৮৮০ সালে ইন্তেকাল করেন ফাতিমা। তার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি আজও জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে। ইউনেস্কো এবং গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বীকৃতিও দিয়েছে।