
দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে হৃদয়বিদারক দীর্ঘ ইতিহাস। ইংরেজরা ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করে। পরবর্তীতে ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে ব্যবসার ছদ্মবেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটি প্রতারক চক্র আসে। তখন ভারতবর্ষের শাসক ছিলেন বাদশা জাহাঙ্গীর। ইংরেজরা তাকে বোঝাতে লাগল, এ দেশের পণ্য ইংল্যান্ডে রপ্তানি করে লভ্যাংশ দিয়ে দেশের উন্নয়ন করবে। বাদশা জাহাঙ্গীর তাদের ফাঁদে পা দেন। তাদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দেন। রাতারাতি তারা অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যায়। বাদশা জাহাঙ্গীর বিঘা বিঘা জমি তাদের নামে বরাদ্দ দিতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যেই ইংরেজরা হয়ে গেল নব্য জমিদার ও ধনে-জনে বিরাট শক্তির অধিকারী। এভাবে ১০০ বছর পর তারা শাসন করতে লাগল ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল। (মুফতি মুহাম্মাদুল্লাহ কাসেমি, দারুল উলুম দেওবন্দ কি জামে ওয়া মুখতাসার তারিখ : ১/৬৫)। ১৭১৭ সালে মৌসুর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকায় তারা শাসন করতে থাকে। ১৭৪০ সালে আরও কয়েকটি প্রদেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এদিকে ১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানী দিল্লির অধিবাসী আবদুর রহিমের ঘরে জন্ম নেন এক মহাপুরুষ। ইতিহাস যাকে ‘শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি’ নামে স্মরণ করে। হাদিসের জগৎ যাকে ‘মুসনিদুল হিন্দ’ নামে চেনে। যিনি ছিলেন এ উপমহাদেশের সর্বপ্রথম সিহাহ সিত্তাহর দরসদানকারী শায়খ। ইলমের জগতে যার খেদমত অপরিসীম। যার দূরদর্শিতা সর্বজন স্বীকৃত। তিনি ২৯ বছর বয়সে ১৭৩১ খ্রিষ্টাব্দে হেজাজ সফর করেন। মক্কা-মদিনার শায়খদের কাছে ইলমি তৃষ্ণা নিবারণ করেন। দু’বছর পর দেশে ফিরে আসেন। মাদ্রাসায়ে রহিমিয়াতে দরস-তাদরিসে নিজেকে ধন্য করেন। তখন তিনি বলেছেন, ‘হিন্দুস্তান তো ইংরেজদের কব্জায় যাওয়ার বেশি দেরি নেই। অচিরেই ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা ইংরেজরা ছিনিয়ে নেবে।’ এর কিছুদিন পরেই ইংরেজরা ঘোষণা দিল, ‘দেশ বাদশার। আইন আমাদের। শাসনক্ষমতা কোম্পানির।’ তখন দিল্লি শহরেই দশ হাজারের বেশি মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। (শায়খ সাইয়িদ মাহবুব রিজভি, তারিখে দারুল উলুম দেওবন্দ : ১/১৩৫-১৫৫)।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়া : ১৭৩৯ সালে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহ.)-এর ঘরে জন্ম নেন এক মহামানব। ইতিহাস যাকে ‘শাহ আবদুল আজিজ’ বলে জানে। ১৭৬২ সালে তিনি পিতার মসনদে সমাসীন হন। ১৭৬৩ সালে দেখলেন, ভারতবর্ষের অনেক এলাকা ইংরেজদের দখলে। শাসন আর শোষণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা মজবুত করছে ইংরেজরা। শাহ আবদুল আজিজ ১৭৭২ সালে সর্বপ্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখেন এবং ঐতিহাসিক ফতোয়া দেন। নির্ভয়ে দ্বীপ্তকণ্ঠে স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেন, ‘মাতৃভূমি ভারতবর্ষ আজ ইংরেজ কবলিত দারুল হরব। সুতরাং তা মুক্ত করতে জিহাদ ফরজ।’ অপরদিকে মহিশুর রাজ্যের শাসক হায়দার আলীর ঘরে জন্ম নেন তারুণ্যের গৌরব, সিপাহে ইসলামির অহংকার টিপু সুলতান। তিনি আজিজি ফতোয়া আর আজাদি চেতনা নিয়ে রণাঙ্গনে নামলেন। মুসলমানের ওপর জিহাদ ফরজে আইন জেনে ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে ৩০০ শিষ্য ও বিরাট মুসলিম বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
ইংরেজদের কূটকৌশল : ইংরেজ বেনিয়ারা যখন ব্যর্থ হতে লাগল এবং জমিন তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেল, তখন শক্তি-সামর্থ ও বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে অসৎ চিন্তা শুরু করল। মুসলিম নেতাদের লোভ-লালসার ফাঁদে ফেলল। তাদের গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হলো মুসলিম নেতা মীর সাদেক। শত্রুর কাছে মুসলমানদের গোপন তথ্য ফাঁস করল। রাতারাতি মীর সাদেক হলো ৯০০ বিঘা জমির মালিক। ইতিহাস তাকে বিশ্ব মুনাফিক হিসেবে জানে। এভাবেই মুসলমানদের মাঝে দুটি দল হলো। একটি দল ইংরেজদের টাকায় কেনা গোলাম। তাদের সহযোগিতায় নিয়োজিত। মুসলমানদের সঙ্গে গাদ্দারি করে ইংরেজদের হাতে হাত মেলাল। আরেকটি দল তখনও টিপু সুলতানের মতাদর্শে বিশ্বাসী। শাহ আবদুল আজিজ (রহ.)-এর ফতোয়ার ওপর সিসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় অবিচল সৈনিক হিসেবে কাজ করল। যুদ্ধ করতে করতে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে টিপু সুলতান শহিদ হলেন।
বিশ্বাসঘাতকতার নতুন রূপরেখা : ইংরেজরা ভাবতে থাকে, পথের সবচেয়ে বড় বাধা দূর হলো। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। তখন নবাব সিরাজুদ্দৌলা মুসলিম জাতির পতন ঠেকাতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। তিনি পলাশীর যুদ্ধের মহান নেতা ও বীর যোদ্ধা। এ যুদ্ধ মোট ২২ ঘণ্টা ছিল। ইংরেজরা নবাব সিরাজুদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফরকে অর্থের লোভ দেখিয়ে কিনে নেয়। মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য অমিটন নামে আরেকজন মুনাফিক পেল। এ দুজনকে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাল। কয়েকদিন পর নবাব সিরাজুদ্দৌলা পরাজিত ও শহিদ হন। ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। ১৮০১ থেকে ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাঞ্জাব শাসন করে রাজা রঞ্জিত সিং। সে মুসলমানদের ওপর অমানবিক ও পৈশাচিক নির্যাতন করে। মুসলিম পরিবারের ওপর জুলুমের স্টিমরোলার চালায়। এমনকি মসজিদগুলোও ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করেছিল। তার এ নির্মমতার কথা বেরেলি শহরেও পৌঁছায়।
সাইয়িদ আহমদ শহিদের নেতৃত্বদান : সে সময় বেরেলিতে সাইয়িদ আহমদ শহিদ নামে বিখ্যাত বুজুর্গ জন্মেছিলেন। জ্ঞানের জন্য তিনি বেরেলি থেকে দিল্লি চলে যান। শাহ আবদুল আজিজ (রহ.)-এর কাছে ইলম ও মারেফত অর্জন করেন এবং তার হাতে বাইআত হন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহ.)-এর ছোট ছেলে শাহ আবদুল গনি (রহ.)-এর ছেলে ছিলেন ইসমাইল শহিদ (রহ.)। তিনি সাইয়িদ আহমদ (রহ.)-এর শিষ্য ও মুরিদ হন। যখন রাজা রঞ্জিত সিংয়ের জুলুম বেড়েই চলছিল, তখন সাইয়িদ আহমদ শহিদ (রহ.) ১৮২৬ সালে ৭৫০ জন মুজাহিদসহ ১০ হাজার লোকের বিশাল বাহিনী নিয়ে পাঞ্জাব রওনা হন। এর আগে ইসমাইল শহিদ (রহ.)-কে দূত হিসেবে রাজার কাছে পাঠান। তিনি ফিরে এসে জানান, রাজা রঞ্জিত মুসলমানদের নির্যাতন করেই চলছে এবং মসজিদগুলো আস্তাবলে পরিণত করছে। ১৮২৭ সালে সাইয়িদ আহমদ (রহ.) পাঞ্জাব গিয়ে জিহাদ করেন। চলতে থাকে তুমুল লড়াই। পেশাওয়ার এলাকা জয় করেন। ইসমাইল শহিদ (রহ.) ঘোষণা করেন, ‘আজ থেকে এ এলাকার আমিরুল মুমিনিন সাইয়িদ আহমদ বেরেলবি। চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবি বন্ধ।’ ক্রমাগত বিজয় হতে লাগল বিভিন্ন অঞ্চল। রঞ্জিত সিংয়ের মনে ভয় ঢুকে গেল। উপায়ন্তর না পেয়ে শায়খের কাছে দূত পাঠাল, ‘আপনার বিজিত অঞ্চল আপনি শাসন করেন। সেখানে রাজার কোনো ক্ষমতা থাকবে না। রাজা তার অঞ্চল শাসন করবেন। তার শাসনও থাকবে সীমিত। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ রাখুন।’ রাজার বার্তা শুনে সাইয়িদ আহমদ শহিদ (রহ.) বললেন, ‘হে বেঈমানের দল! এখানে আমি কোনো রাজত্ব করতে আসিনি। আমার শাসনেরও প্রয়োজন নেই। নির্যাতিত উম্মাহর পাশে দাঁড়াতে এসেছি। জিহাদ ফরজ বিধান। একে আল্লাহর জমিনে পুনঃবাস্তবায়ন করতে এসেছি।’ (পাকিস্তানের আল্লামা জিয়াউর রহমান ফারুকি রহ.-এর সংক্ষিপ্ত ভাষণ থেকে সংগৃহীত)।
বালাকোটের যুদ্ধ ও তার ফলাফল : জিহাদ করতে করতে ১৮৩১ সালের পহেলা মে তিনি বালাকোট ময়দানে পৌঁছেন। সেখানেরও কিছু মুনাফিক দল রাজা রঞ্জিত শিংয়ের বাহিনীর কাছে তাদের খবরাখবর পৌঁছে দেয়। এদিকে মুসলিম সেনা মুজাহিদের বাহিনীতে জন্ম নেয় একশ্রেণির গাদ্দার দল তাগুত। অবশেষে ৫ মে ১৮৩১ সালে তাহাজ্জুদের সময় সাইয়িদ আহমদ শহিদ (রহ.)-কে নির্মমভাবে শহিদ করে শত্রুরা। অপরদিকে শাহ ইসমাইল শহিদ (রহ.) লাগাতার লড়তে থাকেন। টানা সাড়ে চারদিন তুমুল লড়াইয়ের পর শত্রু তার দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে চিরতরে শহিদ করে দিল। বেঁচে যাওয়া সামান্য কিছু মুসলিম পরাজয় বরণ করে ফিরে আসেন। তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় একশজনের মতো। তাদের অন্যতম হলেন জাফর আহমদ থানেশ্বরী, বেলায়েত আলী ও মামলুক আলী এবং ইয়াহয়া আলী (রহ.)-সহ প্রমুখ।
জিহাদ ও আন্দোলনের ভিন্ন রূপরেখা : বেঁচে যাওয়া মুসলমানরা পরাজয়ের দুঃখ নিয়ে দিল্লিতে পরামর্শে বসেন। কিন্তু তাদের নেই শক্তি বল। না আছে জনশক্তি, না আছে অর্থশক্তি। অস্ত্রশস্ত্রও শুন্যের কোটায়। এমনই এক ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পরামর্শে বসেন ক্ষুদ্র একটি দল। কিন্তু স্বাধীনতার চেতনায় ভরা হৃদয় এ কাফেলা কারো কাছে নতজানু করতে জানে না। কারও সামনে মাথা ঝুঁকায় না। একে একে ১৪ হাজার আলেমকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হলো। তারপরও নত শির করেননি তারা। এভাবে চলতে থাকল দুয়েক যুগ। ১৮৫৬ সালে দিল্লিতে ভারতবর্ষের বড় বড় আলেমদের পরামর্শ হলো। তাদের অন্যতম হলেন- হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরি মক্কি, মুফতি রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি, মাওলানা কাসেম নানুতবি, জাফর আহমদ থানেশ্বরী ও হাফেজ জামিন শহিদ (রহ.)-সহ প্রমুখ।
মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) বললেন, ‘ইংরেজ আমাদের মাথায় উঠে বসে আছে। দিনদিন তাদের নির্যাতন বেড়েই চলছে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তাদের ক্ষমতা। এভাবে যদি চলতে থাকে, ভারতবর্ষ সারাজীবন গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ থাকতে হবে। তাই যার যা আছে, তা নিয়ে এদের বিরুদ্ধে জনমত ঐক্য হয়ে জিহাদ করতে হবে।’ উক্ত মজলিসে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের তো লোকসংখ্যাও কম, আবার অস্ত্রশস্ত্রও না থাকার মতো। কীভাবে লড়ব স্বশস্ত্র বাহিনীর মোকাবেলায়?’ মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) বজ্রকণ্ঠে স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘স্মরণ কর সে সময়কে, বদরের মুজাহিদরা কি আমাদের চেয়ে কম ছিল না! তাদের অস্ত্র কি-ই বা ছিল! জিহাদ চলবেই চলবে। জিহাদ কোনোদিন অস্ত্রের মুক্ষাপেক্ষী নয়।’ শুরু হলো স্বাধীনতা আন্দোলন। হিন্দুস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুটি যুদ্ধ হয়- এক. ১৮৫৭ সালে আজাদি আন্দোলন। যার মহানায়ক ছিলেন মুহাজিরে মক্কি (রহ.)-এর শাগরিদ মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.)। যে যুদ্ধে মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.) নিজেই আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং আহত হন মুফতি রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.) ও তার শায়খ মুহাজিরে মক্কি (রহ.)-সহ অনেকে। দুই. রেশমি রুমাল আন্দোলন। যার মূলে ছিলেন মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.)-এর শাগরিদ শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি (রহ.)। কিন্তু আফসোস, এ আজাদি আন্দোলনেও বিজয় এলো না। (পাকিস্তানের আল্লামা জিয়াউর রহমান ফারুকি (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত ভাষণ থেকে সংগৃহীত)।
ইংরেজদের অপতৎপরতার কাহিনি : আঠারো শতাব্দীর কথা। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ভারত উপমহাদেশের মুসলমান তথা আলেম সম্প্রদায়ের ওপর এক লোমহর্ষক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তারা দিনের পর দিন শহিদের বিকৃত লাশ গাছের ডালে ডালে ঝুলিয়ে রাখে। তখন কোনো আলেমকে দেখলেই পাষ-রা নির্বিচারে হত্যা করত। এক তথ্যমতে, ১৮৬৪ সাল থেকে ৬৭ সাল পর্যন্ত ১৪ হাজার মুসলিম জাতির ধর্মীয় নেতা উলামায়ে কেরামকে নির্মমভাবে শহিদ করা হয়। গ্রাম থেকে গ্রাম খুঁজেও একজন আলেম পাওয়া যেত না। দিল্লি থেকে খায়বারে গ্রান্ড ট্রাংক (জিটি রোড)-এর পাশে এমন কোনো গাছ ছিল না, যার সঙ্গে আলেমদের লাশ ঝুলানো ছিল না। ইতিহাসবিদ থিমসন বলেন, ‘এমন কোনো নির্যাতন নেই, যা ভারতবর্ষের আলেমদের ওপর করা হয়নি। ইংরেজরা মৌলবিদের লাশকে শূকুরের চামড়া দিয়ে আবৃত করে রেখেছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘জ্বলন্ত আগুনে গরম তেল ফুটানো হতো। সেখানে নিক্ষেপ করা হতো জীবিত আলেমদের। একজনের সামনে আরেকজনকে ফুটন্ত তেলে সরাসরি নিক্ষেপ করা হতো। তারপরও কেউ মাথা নত করেনি ইংরেজদের সামনে। ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত ইতিহাসের নির্মম হতাযজ্ঞ করে ইংরেজরা। ওলামায়ে হিন্দ হয় নির্যাতনের শিকার। সেটাই ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেশি শোক ও দুঃখের বছর ছিল। এভাবে ধীরে ধীরে নেমে এসেছিল অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুসংস্কৃতি, শিরক, বিদআতের এক চরম দুর্যোগ। অপরদিকে ব্রিটিশরা সিদ্ধান্ত নিল, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থায়ী করতে হলে ভারতীয় মুসলমানদের আর্থিক অভাব-অনটন ও চরম দুরাবস্থায় ফেলতে হবে। তাদের অন্তর থেকে কোরআনের আলো চিরতরে নেভাতে হবে। মুসলিমবিদ্বেষী ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ব্রিটিশ জাতীয় সংসদ অধিবেশন চলাকালে কোরআন তুলে বলেছিল, ‘যতদিন এ কিতাব থাকবে, ততদিন পৃথিবী কৃষ্টি ও সভ্যতা লাভ করতে পারবে না।’ এরই প্রেক্ষিতে ইংরেজরা ১৮৬১ সালে ভারতবর্ষে তিন লক্ষ কোরআনের কপি জ্বালিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষানীতি সম্পর্কে ইল্যান্ডের লর্ড ম্যাকালে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিল, ‘ভারতীয়দের জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, এমন এক যুবসম্প্রদায় সৃষ্টি করা, যারা বংশে ভারতীয় হলেও মন-মস্তিষ্কে হবে খাঁটি বিলেতি।’ এ হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানা আইন জারি করে তারা। মুসলমানদের থেকে জমিদারি কেড়ে প্রতিবেশী হিন্দুদের মাঝে বণ্টন করে দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি- এক কথায় জীবন-জীবিকার সকল ক্ষেত্র থেকে মুসলমানদের বঞ্চিত রাখে। তখন ফার্সির স্থানে ইংরেজি ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে মুসলমানদের ঈমান-আকিদা বিনষ্টের এক সুপরিকল্পিত হীন প্রয়াস চালায়। (মুফতি মুহাম্মাদুল্লাহ কাসেমি, দারুল উলুম দেওবন্দ কি জামে ওয়া মুখতাসার তারিখ : ১/৪৭)।